মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। সব মা-ই সন্তানকে সুখী দেখতে চান। ছেলের বিয়ে দিয়ে ছেলেকে সংসারী করেন, আবার মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে তাকে সুখ-শান্তিতে সংসার করতে দেখতে চান। মেয়ে যাতে অচেনা বাড়িতে গিয়ে বউমার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে পারে, তার জন্য ছোটো থাকতেই সঠিক শিক্ষা দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেন মা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংস্কারেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক পরিবেশে বিয়ে শব্দটার সংজ্ঞাও বদলেছে।
অতীতে মেয়ের বিয়ের পর, অপরিচিত শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সেখানে সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলাটাকে একটা সমস্যা পার করে আসা মনে করা হতো। আর এখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে বনিবনা ঠিকমতো হয়ে গেলেই বিয়ে সফল হয়েছে বলে মনে করা হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে আজ পুঁথিগত বিদ্যার নানা ডিগ্রি রয়েছে কিন্তু বাস্তবে ব্যবহারিক বুদ্ধির অভাব রয়েছে।
বিয়ের পর Husband-Wife উভয়েকেই অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয় যে কারণে একে অপরের সহযোগিতা পাওয়াও একান্ত কাম্য। কিন্তু প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে মেয়েদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব, যার ফলে স্বামী-স্ত্রী কথায় কথায় একে অপরকে নীচ প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় সময় অতিবাহিত করছে।
বিবাহিত জীবন সফল করতে যেমন Husband-Wife এর মধ্যে বোঝাপড়া দরকার ঠিক তেমনই দুটো পরিবারের সদস্যদেরও ইতিবাচক ভাবনাচিন্তা ও ব্যবহারও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ— একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মতবিবাদ বাড়ায় মোবাইল
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক সময় বিবাদের কারণ হয় মোবাইল। মোবাইলের মাধ্যমে মেয়ের বাপের বাড়ি, আত্মীয়স্বজন এবং তার বন্ধুবান্ধবদের সবসময় মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছে। ফলে মেয়ের ফোন সবসময় বেজেই চলেছে।
আজকাল মেয়েরা শ্বশুরবাড়ির তুচ্ছ ঘটনাও নিজের বন্ধুবান্ধব বা বাপের বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে। আর তারাও নিজেদের মতামত মেয়ের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা মেয়েকে পরামর্শ দেয়, শ্বশুরবাড়ির সবকিছু মেনে না নিতে। নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখতে।
‘সমস্ত দায়িত্ব কি শুধু আমার…’ এই ধরনের উত্তেজক কথা বলে মেয়েটির মনের ভিতর শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে বিদ্বেষ ঢোকাতে থাকে৷ এই ধরনের কথাবার্তা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি করে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ায়।
সব পরিবারের নিয়ম আলাদা, তাদের গুরুত্ব দেওয়ার মতো বিষয়গুলিও আলাদা, বাজেট আলাদা। সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে স্নেহা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসেই কখনও সোফা, কখনওবা বাড়ির পর্দা বদলাবার জন্য জোরাজুরি করত স্বামীকে। সময় সুযোগে গাড়ি কেনার ডিমান্ডও করেছে। ওর স্বামী ভালো ভাবে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করত। কিন্তু স্নেহার বন্ধুরা, ওর বাপের বাড়ির আত্মীয়স্বজনেরা ফোন করে করে ক্রমাগত বলতে থাকে, তোর বাড়ির পর্দাগুলো খুব পুরোনো হয়ে গেছে, সোফাটা তোর শ্বশুর-শাশুড়ির বিয়ের সময়কার হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরে ধীরে এই কথাগুলোই স্নেহার বিবাহিত জীবনে ভাঙন ধরিয়েছিল।
ঝগড়ার ছোটো ছোটো কারণ
স্নেহার স্বামী ধার করে আয়েশে জীবন কাটানোতে বিশ্বাসী নয়। ভবিষ্যৎ নিয়ে সে-ও যথেষ্ট চিন্তা করত। নিজের একটা বাড়ি করার চেষ্টায় সে অর্থ সঞ্চয় করে যাচ্ছিল। কিন্তু স্নেহার রোজ রোজ চাহিদার মাত্রা বাড়তে থাকায় সম্পর্কে ভাঙন দেখা দেয়। স্নেহা এখন বাপের বাড়িতে রয়েছে। কিন্তু অন্যের কথা শুনে সুখের সংসার ভাঙার জন্য ও আজ অনুতপ্ত!
সম্পর্ক ভাঙার জন্য মোবাইলকে অনেকেই দায়ী করেন। ফোনের কারণেই অপরের অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ মেয়ের সংসারকে বিষাক্ত করে তোলে। এটা এখন শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নয়, গ্রামেও এর রেশ পড়তে শুরু করেছে। গার্হস্থ্য হিংসার মোকদ্দমায় মীমাংসা করানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ছোটো ছোটো ঝগড়ার কারণ সম্পর্কে জানা যায়। তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ-ই Husband-Wife এর মধ্যে বিরোধের প্রধান কারণ দেখা যায়।
বর্তমানে ভিডিওকল-এর মাধ্যমে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির প্রতিটা কোণা বাপের বাড়ির সদস্যদের নখদর্পণে। মেয়েকে যদি রান্নাঘরে মা দেখতে পান তাহলে হিতৈষী হয়ে ওঠার প্রবল চেষ্টায় মেয়ের কানে বিষ ঢেলে দেন— ‘কী ব্যাপার, হাত পুড়িয়ে ঘেমে নেয়ে তুই রান্না করছিস আর শাশুড়ি বুঝি এসি-তে বসে গল্পে মত্ত।’
আবার কখনও জামাইয়ের প্রসঙ্গ টেনে এনে মেয়েকে প্রবোধ দেওয়ারও চেষ্টা চালান মায়েরা। যেমন— অলোককে সবসময় দেখি মা আর দাদা-বউদির মতে চলতে, দেখিস তোকে আদৌ ভালোবাসে তো অলোক? বাঁধন আলগা করিস না কিন্তু, পরে পস্তাবি। কখনও বিয়েবাড়িতে একসঙ্গে শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়ির নিমন্ত্রণ থাকলে, বাড়ি ফিরেই মেয়েকে অনেক সময় নিজের মায়ের প্রশ্নের সামনে পড়তে হয় যেমন, ‘হ্যাঁরে দেখলাম তোর শাশুড়ি তোর বালা আর চুড়িগুলো পরেছিল। সোনার গয়না বিশ্বাস করে কেন পরতে দিয়েছিস?’ এই ধরনের ছোটো ছোটো কথাগুলোই দাম্পত্যে বড়োসড়ো ফাটল ধরায়।
বুঝতে না চাইলে বোঝানো অসম্ভব
ভালোবাসা, মোহ-মমতার মুখোশধারী শুভানুধ্যায়িদের কে বোঝাবে — শ্বশুরবাড়িতে যে-মেয়েকে পাঠানো হয়েছে সে নিজেই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। নিজের দেখাশোনা করার ক্ষমতা তার রয়েছে। সব বাড়ির আলাদা আলাদা নিয়মনীতি। মেয়ে যদি আনন্দে থাকে, শ্বশুরবাড়িতে তাকে বেশি কাজ করতে হলেও মনে রাখতে হবে এই ভাবেই শ্বশুরবাড়িতে সকলের কাছে সে প্রিয় হয়ে উঠবে। বুঝতে হবে এই কাজের জন্য মেয়েও কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের বাহবা কুড়োচ্ছে এবং এটাই ধরে নেওয়া হবে মেয়ে বাপের বাড়িতে ভালো শিক্ষা পেয়ে মানুষ হয়েছে।