কেউ বলছে ডাক্তার ডাকতে, কেউ বা হাসপাতালের কথা। অঙ্গিরা জোর করে উঠে বসে বারণ করল সবাইকে। জানাল সে সম্পূর্ণ ঠিক আছে। কিন্তু নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেল। সে কী স্বপ্ন দেখছে! সে মৃত না জীবিত। এতগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েও কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই শরীরে! তার তো এতক্ষণে এই চরাচর ছেড়ে দেওয়ার কথা। তাহলে কী! ওষুধের মধ্যেই কোনও কারসাজি! রঙ্গন তার প্রখর বুদ্ধি দিয়ে হারিয়ে দিল অঙ্গিরার অবধারিত মৃত্যুকে। কিন্তু রঙ্গনের কী হল! এবার সেই ভেবে উতলা হয়ে উঠল অঙ্গিরার মন। সে তো আর মোবাইলের যুগ নয়, দৌড়ে গেল ল্যান্ড লাইনের দিকে। হাত কাঁপছে, ডায়াল করতে পারছে না, আঙুল জড়িয়ে যাচ্ছে। অবশেষে লাগল রঙ্গনদের বাড়ির নম্বর। জানা গেল বেশ কিছুক্ষণ আগেই রঙ্গন নাকি হিমাচল ঘুরতে যাচ্ছে বলে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল অঙ্গিরার। কিছুদিন পর ওষুধের শিশির ভেতর সাদা গুঁড়ো পরীক্ষা করে জানা গেল, সেগুলো অতি সাধারণ ক্যালশিয়ামের বড়ি ছিল। ভালোবাসা আরও গভীরে নোঙর ফেলল অঙ্গিরার ডুবোপাহাড়ের ভেতরে।
এরপর রঙ্গনদের পরিবার আরও বছর দুই ছিল ওই পাড়ায়। ততদিন পর্যন্ত এক দিনের জন্যেও ফেরেনি নিখোঁজ রঙ্গন। রঙ্গনদের পরিবার এই পাড়া ছেড়ে চলে যাবার আগে এক অদ্ভুত খবর এল তাদের বাড়ি। দেরাদুনের কাছে এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় একটি দলা পাকানো দেহ পাওয়া গেছে। চেনার কোনও উপায় নেই। পাশের পড়ে থাকা টিকিটের সূত্র ধরে আন্দাজ করা হচ্ছে এটা নাকি রঙ্গন মিত্র। রেলওয়ে জিআরপি এরকমই খবর দিল। পাড়ার দু’একজনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটল রঙ্গনের পরিবার। শোনা যায় ওখানেই নাকি দাহ করে এসেছিল সেই অশনাক্ত রঙ্গনকে। তারপর বাড়ি ফিরে রঙ্গনের শ্রাদ্ধ শান্তি-ও হল। চিরকালের মতো অঙ্গিরার জীবনের একটা রঙিন অধ্যায় সাদা হয়ে গেল।
নিয়মভঙ্গের দিন অঙ্গিরা শেষবারের মতো গিয়েছিল ওদের বাড়ি। যে রঙ্গনের গলায় মালা দেওয়ার কথা ছিল ওর, তার কাচের ফ্রেমেবন্দি হাসিভরা মুখচ্ছবিতে মালা দিয়ে এল। আজ ওটাতো একটা জড় পদার্থ। তার আর কোনও হেলদোল নেই। হা ঈশ্বর! অঙ্গিরা মনে মনে ভাবল, যখন যাত্রীভরা নৌকাডুবি হয়, তখন যারা বেঁচে যায়, তারা ভাবে ঈশ্বর অপার করুণাময়, অথচ যারা ডুবে মরছে তারা ঠিক তখনই বুঝতে পারে ঈশ্বর আসলে কত নির্মম।
তারপর ওর বাবা-মায়েরাও চলে গেল এই পাড়া ছেড়ে। বলেও যায়নি কাউকে। আসলে একমাত্র ছেলে চলে যাওয়ায়, পুরোনো স্মৃতিকে আর টেনে নিয়ে যেতে চাইল না তারা। পুরোনো যোগাযোগ থাকা মানেই সেইসব ফেলে আসা দিনের অপ্রিয় স্মৃতির রোমন্থন। যেটা তারা একেবারেই চাইল না। তাই পাড়ায় আর কেউ জানেও না ওদের খবর।
এদিকে একবার আত্মহত্যার হাত থেকে বরাতজোরে বেঁচে যাওয়ায় ভীষণ চোখে চোখে রাখা শুরু হল অঙ্গিরাকে। বিশেষ করে ওর মা এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতেন না অঙ্গিরাকে। শুরু হল ওর মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা। কিছুদিনের মধ্যেই রাজি করিয়ে মোটামুটি মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বসিয়ে দেওয়া হল বিয়ের পিঁড়িতে। চার হাত এক হয়ে গেল পুলকের সাথে। সংসারের সুখের অভ্যাসে অনেক তলানিতে চলে গেল ফেলে আসা স্মৃতি। বিয়ের দু’বছরের মাথায় কোলে এল মেয়ে। সংসার ভরে উঠল অপত্য স্নেহে। দায়িত্ব কর্তব্যের পুরু ধুলো পড়ে গেল কিশোরীবেলার সেই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ওপর। অঙ্গিরার মন থেকে অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে গেল রঙ্গনের গল্প।
তারপর হঠাৎ এই আজকের সকাল। মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, এই রঙ্গন মিত্র কি সেই রঙ্গন? নাকি একই নামের কোনও আলাদা মানুষ। মনের গভীরে আবার একটা নিস্তব্ধ আলোড়ন হচ্ছে। যার ঢেউ’র কোনও বহিঃপ্রকাশ বাইরের চেহারায় নেই। কিন্তু এখন উপায়! কীভাবে যোগাযোগ করা যায় রঙ্গনের সাথে? একবার পত্রিকা অফিসে কি ফোন করা উচিত হবে? দোটানায় অঙ্গিরা। তবু মন মানছে না। শেষমেশ নিজেকে আর দমন করে রাখতে পারল না। ফোন করেই ফেলল পত্রিকা অফিসে।
—হ্যালো…?
—আমি অঙ্গিরা বসু বলছি, আচ্ছা গত রবিবার আপনাদের কাগজে যে-গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে, তাঁর লেখক রঙ্গন মিত্রের ফোন নম্বরটা কি পাওয়া যাবে?
—না, মাপ করবেন। লেখকের অনুমতি ছাড়া তো তার ফোন নম্বর কাউকে দেওয়া তো সম্ভব নয়।
—তাহলে কি কোনওভাবেই ওনার সাথে যোগাযোগ করা যাবে না?
—আপনি একটা কাজ করতে পারেন, আপনার ফোন নম্বরটা আমাকে দিন, আমি রঙ্গনবাবুকে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করব। এইটুকু করতে পারি বড়োজোর।
—অসংখ্য ধন্যবাদ।
এরপর প্রায় দিন সাতেক কেটে গেল। অঙ্গিরা হতাশ হয়ে পড়ল। ধরেই নিল যে, রঙ্গন সত্যি সত্যিই আর এই দুনিয়াতে নেই। তার মানে ওটা আসলে রঙ্গনেরই মৃতদেহ ছিল। মনের কোণে যেটুকু দোলাচলের নিষ্পাপ কুঁড়ি টিকেছিল, সেটাও ঝরে গেল। ধরেই নিল, এই রঙ্গন মিত্র আলাদা এক মানুষ। দোল এসে গেল। পুলকের সেদিন ছুটি। অঙ্গিরাদের ফ্ল্যাটে হই হই করে রং খেলা হচ্ছে। কাউকে চেনা যাচ্ছে না। সবাই রং মেখে অন্য চেহারা। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল অঙ্গিরার। মেয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘মা তোমার ফোন।’ দৌড়ে গেল অঙ্গিরা।
—হ্যালো…?
ওপার থেকে এক গুরুগম্ভীর পুরুষ কন্ঠস্বর ভেসে এল। অবিকল সেই বহু বছর আগে শোনা বড়ো চেনা অঙ্গিরার এই কন্ঠস্বর। ঝলমলিয়ে উঠল অঙ্গিরা, গলা কেঁপে উঠল, এক নিঃশ্বাসে বলে গেল, ‘কেমন আছো? এতদিন কোথায় ছিলে? আমি অঙ্গিরা!”
—পত্রিকা অফিস থেকে আপনার নম্বরটা দিল। আপনি নাকি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন, তাই ফোন করলাম! আমি তো ঠিক আপনাকে চিনতে পারলাম না! কে আপনি?
চুপ করে গেল অঙ্গিরা। ভেজা গলায় বলে উঠল, ‘মাপ করবেন। আমার বোধহয় কিছু একটা ভুল হয়েছিল। নমস্কার।”
ফোন কেটে গেল। এতদিন অঙ্গিরা মরিয়া ডুবেছিল, এবার ডুবিয়া মরিল রঙ্গনের স্মৃতিতে।