বউদিমণির কথা শেষ হয়ে গেলে আহির তাঁকে যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলে— মৃত্যু ব্যাপারটা অবশ্যই দুঃখের, বিশেষত এই ধরনের অপমৃত্যু। কিন্তু এই মুহূর্তে অঘটনটাকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই। সবই ভাগ্য আর ভবিতব্যের খেলা, এরই নাম নিয়তি। এতে কারওর হাত নেই। এই বিশ্বসংসারে আপনজনের কি কখনও মৃত্যু হতে পারে? বিশু ছিল আমাদের একান্ত আপনজন। আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় ও চিরদিন সজীব হয়ে থাকবে। ওর মৃত্যু নেই। ও আমাদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গিয়েছে শুধু, মনের আড়ালে যেতে পারেনি। মৃত্যু জিনিসটা আর কিছুই নয় পঞ্চভূতে গড়া এই শরীরের কল্পনা থেকে বেরিয়ে আপন সত্ত্বার গভীরে ডুবে যাওয়ার নামই মৃত্যু।
বউদিমণি চোখের জলের ধারায় ভেসে যাচ্ছিল। ভালো করে কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেবলই কাঁদছিল। আহির বউদিমণির মুখপানে এমন ভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে যে, বিশু সম্পর্কে তার মুখে বলা যাবতীয় সান্ত্বনা বউদিমণির চোখের জলের ধারায় ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো কিছু বলতে না পেরে আহির নিথর নিস্পন্দ অবস্থায় চুপ করে বসে থাকে। ভীষণ অসহায় লাগছিল নিজেকে। সে নির্বাক শ্রোতার মতো বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বউদিমণির বেদনাবিধুর অন্তরের কথাগুলো আগ্রহ সহকারে কেবল শুনতে থাকে। এছাড়া তার করণীয়ও কিছু ছিল না।
এরপর বউদিমণি যা ব্যক্ত করেন তা আরও ভয়ংকর ও সাংঘাতিক খবর— আমার মেজদা সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়ি আসতে গিয়ে দিল্লির ডিটিসি বাসের সঙ্গে অটো রিক্সার ধাক্কা লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। বউদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে এতদিন রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আমার বাড়িতে আসেনি, আমার বাপের বাড়ির আত্মীয়রা এসে বউদিকে হাসপাতাল থেকে সোজা লখনউ নিয়ে গিয়েছে। ওদের ধারণা আমি নাকি অপয়া। আমার বাড়িতে এলে কেউ আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। ওরা স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জীবনে আর কখনও আমার বাড়িমুখো হবেন না।
আহির চিত্রার্পিতের ন্যায় স্থবির হয়ে বসে থাকে। বলার মতো কথা সে খুঁজে পায় না। বউদিমণির উদ্দেশ্যে তাঁর বাপেরবাড়ির দেওয়া নিদারুণ অপমান ও অপবাদে আন্তরিক সহানুভূতি জানাতে গিয়ে নিজের অজান্তে অন্তর্গভীর থেকে বেরিয়ে আসে সকরুণ দীর্ঘশ্বাস। বউদিমণির কান্নায় ঘরের বাতাস পর্যন্ত ভারী হয়ে গিয়েছিল। বুকের খাঁচাটায় যেন কালবৈশাখীর ঝড় বইতে থাকে। এইরকম অসহনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা আগে থেকে অনুধাবন করা যায়নি। ভীষণ অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল পরিবেশটা। বুক ভরে ভালো করে শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল। কারণ বউদিমণির মুখে বলা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাগুলো শুনতে যেমন কষ্ট হচ্ছিল। আবার অন্যদিকে বউদিমণির হয়ে তার বাপেরবাড়ির উদ্দেশ্যে কটু মন্তব্য প্রকাশ করতেও দ্বিধা হচ্ছিল। আহিরের যুক্তি তর্কগুলো নিমেষে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তে আহিরের মনে হচ্ছিল তার পক্ষে সব কথা নীরবে শুনে যাওয়াটাই একমাত্র সঠিক কাজ। কোনও প্রকার মন্তব্য প্রকাশের অধিকার থেকে সে বঞ্চিত। এক কথায় আহিরের জীবনৃত অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ কারও মুখে কোনও কথা ছিল না।
একসময় বউদিমণিই নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠেছিলেন— ভাবছি মা কালীর নামে একটা পুজো দেব। সত্যি, আমি ভীষণ অপয়া। আমার বাড়ির লোকেরা ঠিকই বলেছে। তা নাহলে এমন ঘটনা কখনও ঘটতে পারে?
(ক্রমশ…)