বউদিমণি বলতে আরম্ভ করেন— খুব দুঃখের সঙ্গে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, জানো আমাদের বিশু আর বেঁচে নেই, ও মারা গিয়েছে। একটু চুপ করে থেকে তিনি আরও জানান, খবরটা জানানোর জন্যে তোমার অফিসে ফোন করেছিলাম। কিন্তু তুমি তখন অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছিলে। ইচ্ছে থাকলেও সময়মতো খবরটা জানাতে পারিনি। বিশু চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে মারা গিয়েছে। সরকারি কাজে লখনউ থেকে ও আমার এখানেই আসছিল। সে রেল কর্মচারী ছিল।
বিশু বউদিমণির বড়ো বোনের একমাত্র ছেলে। ওদের লখনউতে বাড়ি। অফিসের কাজে ও প্রায়শঃই দিল্লি আসত। বউদিমণির বাড়িতে বসেই একদিন বিশুর সঙ্গে আহিরের আলাপ হয়েছিল, ক্রমে ঘনিষ্ঠতা। তারপর থেকে সে যখনই দিল্লি আসত, অন্তত একবেলার জন্যে হলেও আহিরের সঙ্গে দেখা করাটা তার কর্তব্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছিল। বিশু ভালো বাংলা বলতে পারত না। ওর মুখনিঃসৃত হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত বাংলা কথাগুলি শুনতে ভারি অদ্ভুত লাগত।
কথাচ্ছলে এই কথাটি তার মুখে প্রায়ই বলতে শোনা যেত— দেখে নিও, একদিন বড়োই ধূম সে মেরি জনাজা নিকলেগি। তারপর হাসতে হাসতে বলে উঠত, “যাতি হ্যায় তো যা, জানাজা মেরি ভি লেতি যা/ ও মেরি মোহব্বত, বেজান শরীর কো ছোড়কর না যা'।
কথাটা উচ্চারণ করা মাত্র বউদিমণি তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠতেন। বউদিমণির রাগ প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে বিশু তৎক্ষণাৎ মুখাবয়বে নিষ্পাপ হাসি ছড়িয়ে তার কথার অন্তর্নিহিত মানেটা লঘু করার চেষ্টা করত। অহেতুক তর্ক করতে খুব পছন্দ করত। যার তার সঙ্গে সে তর্ক জুড়ে দিত। হেরে যাওয়ার পরে যখন বলা হতো— মিছিমিছি এত তর্ক করো কেন? প্রতিবারই তো হেরে যাও।
বিশু বলত— -ফজুল ব্যাহেস করতে আমার বেহদ আনন্দ আতা হ্যায়, বহুত কুছ শিখনে কো মিলতা হ্যায়। আখির মেরা হি ফায়দা হোতা হ্যায়। ওর ছেলেমানুষী এবং ভিত্তিহীন যুক্তিতে উপস্থিত সকলে হেসে উঠত। হিন্দি ছবির প্রতি ওর ব্যক্তিগত অনুরাগের কথা জানতে চাইলে বিশু পরম উৎসাহিত হয়ে বলত — লচকে যব কমরিয়া তো সারা দুনিয়া হিলে লা৷ তাই হিন্দি ছবি আমাকে খুব বেশি আকর্ষণ করে। বাংলা সিনেমা জগতের মহানায়ক উত্তমকুমার আর উৎপল দত্তের অভিনয় ছাড়া তার নাকি আর কারওকে পছন্দ নয়। কাল, মহাকাল বা জীবন সম্বন্ধে তার নিজস্ব কোনও মতবাদ ছিল না, এই ব্যাপারে সে ছিল একেবারেই উদাসীন। বিশু ছিল এক বিচিত্র এবং অদ্ভুত মেজাজের ছেলে।