কথার মোড় ঘুরে যাওয়ায় আহির যেন জেলবন্দি জীবন থেকে মুক্তি পায় এমন একটা ভাব তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। একটু নড়েচড়ে বসার পরে অপবাদের হাত থেকে বউদিমণিকে নিষ্কৃতি দেওয়ার অভিপ্রায়ে সে বলে ওঠে— লোকের কথায় কী আসে যায়? তাদের যা খুশি বলতে দিন। কারও মুখের কথায় কেউ অপয়া বা পয়মন্ত হতে পারে না। পৃথিবীতে সকলেই নিজ গন্তব্যে প্রত্যাগমনের জন্য নির্দিষ্ট সময় নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। সময় ফুরিয়ে গেলে সে চলে যায়। এইভাবেই নিরন্তর চলতে থাকে যাওয়া-আসা।

বিশু ও মেজদার মৃত্যু আকস্মিক হলেও তাঁদের অলিখিত অদৃষ্ট অনুযায়ী ওটাই ছিল ভবিতব্য। জীবনের সব ঘটনাই পূর্ব নির্ধারিত। সুতরাং কেউ যদি না জেনেবুঝে অপবাদ দেয় সেটা ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করতে নেই। আপনার আত্মীয়েরা মানসিক ভারসাম্যতা হারিয়ে এসব কথা বলে ফেলেছেন। তাঁরা এখন অপ্রকৃতস্থ। সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে পরে একদিন তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করবেন তাঁদের ভুল। পুজো-আর্চ্চা করলেই যদি অদৃষ্টের চাকা পালটানো যেত তাহলে মানুষের জীবনে দুঃখের কোনও অস্তিত্বই থাকত না। সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সবই যখন ঈশ্বরের হাতে তাহলে অযথা দুঃখ করে লাভ কি?

পুজো দিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? মৃতজনেরা কি ফিরে আসবে আর? এগুলো কুসংস্কার ব্যতীত আর কিছু নয়। কয়েকটা মন্ত্র শুনিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর একটা সুপ্রাচীন পদ্ধতি। পুজো-আর্চায় আমার একটুও আস্থা নেই। যত সব বুজরুকি আর প্রতারণা! দীর্ঘ দিন যাবৎ এক শ্রেণির মানুষ সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে নানা প্রকার ক্রিয়াকর্মের দ্বারা মানুষকে বঞ্চনার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই পৃথিবীতে লৌকিক বা অলৌকিক বলে কিছু নেই, সবই আপেক্ষিক! যে যেমন ভাবে গ্রহণ করে।

সূর্যাস্তের কিছু পরেই আহির সেখান থেকে নিজে থেকেই বেরিয়ে আসতে চাইছিল। কিন্তু বউদিমণির একান্ত অনুরোধে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। নৈশভোজন সেরে বেরোতে বেরোতে রাত্রি হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় নেমে আহির কখন যে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল তা সে নিজেও জানতে পারেনি। নিমেষে প্রচণ্ড এক ধাক্কায় মাথা ঘুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। তারপর সব কিছুই আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল নিবিড় ঘন কুয়াশায়।

আহির অচৈতন্য অবস্থায় পিচ ঢালা রাস্তায় শুয়ে ছটফট করছিল। আশেপাশের পথযাত্রীরা ছুটে এসে প্রাথমিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা সত্ত্বেও তার দিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে অগত্যা বাধ্য হয়ে পুলিশের সাহায্যপ্রার্থী হয়। পুলিশ জামার বুক পকেটে রাখা বউদির বাপেরবাড়ির উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিঠি হাতে পায়। প্রেরকের নাম ঠিকানা লেখা ছিল তাতে। পুলিশের গাড়িতে আহির অচৈতন্য হয়ে শুয়ে ছিল। অতঃপর রামমোহন লোহিয়া হাসপাতালে সে স্থানান্তরিত হয়। প্রথম পাঁচদিন তাকে আইসিইউ-তে রাখা হয়। তখন কারওকেই সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তারপর যেদিন তাকে প্রথম জেনারেল ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হয়, সেদিন তার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। পট্টিবাঁধা অবস্থায় সে শুয়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন মহাকাশ যাত্রী। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল। তবু আহির তার একান্ত প্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয়া বউদিমণির উদ্দেশ্যে যে কথাটি অস্ফুট স্বরে ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছিল তা ছিল এইরকম— বউদি আপনি নিজেকে দোষী ভাববেন না। এ ছিল পূর্বনির্ধারিত।

আহিরের অসহায় মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বউদির চোখ দুটো আবার জলে ভরে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তে অশ্রু বিসর্জনের মাধ্যমে বউদিমণি নিজেকে পুনরায় অপয়া ভাবতে শুরু করেছিল কিনা কে জানে!

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...