পরের দিন রবিবার ছিল তাই সকালবেলা পৌঁছে গেল ওই ঠিকানায়। দিল্লিতে এসে অনিমেষ একটা কথা শুনেছে, এখানে কারও বাড়িতে গেলে সকাল এগারোটার আগে যাওয়া নাকি সবাই পছন্দ করেন না। তাই অনিমেষও বাড়ির খোঁজে গিয়ে পৌঁছোল এগারোটার পর। কলিংবেল টিপতেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। অনিমেষ বাড়ি ভাড়ার কথা বলতেই ভদ্রলোক এমন ভাবে তাকালেন যেন অভাবনীয় কিছু শুনছেন। ভদ্রলোক অবাঙালি। হিন্দিতেই বললেন, ‘ভেতরে আসুন।’
—আজ্ঞে, আমাকে প্রপার্টি ডিলার পাঠিয়েছেন। ঘর দেখার জন্য।
ভদ্রলোক তাকে ঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন ভেতরে। ঘরের ভেতরে ঢুকেই দেখল কতগুলো সুন্দর অয়েল পেন্টিং ঘরের দেয়ালে লাগানো। অনিমেষের মনটা খুশিতে ভরে গেল। ছবিগুলো যেন জীবন্ত। মনে হচ্ছে যেন কথা বলছে। অনিমেষ জানে দিল্লিতে ভাড়া অ্যাডভান্স দিতে হয়। অনেকে তো আবার ‘পাগড়ি’ চায়। অর্থাৎ একসাথে কয়েক মাসের টাকা দিয়ে দিতে হয়। তাই বলল,
—আমাকে কত অ্যাডভান্স দিতে হবে? আমি কালই শিফট করতে চাই। আমার কাছে খুব একটা জিনিসপত্র নেই তাই কালই শিফট করতে অসুবিধে হবে না। আপনাকে ভাড়াটা কি এখন দেব?
—এখন দিতে হবে না। দু’একদিন পরে দিলেও হবে। আপনি আগামীকাল আসুন তারপর দেখা যাবে।
অনিমেষ বেশ একটু অবাকই হল। কারণ শুনেছে এখানে কেউ অগ্রিম ছাড়া বাড়ি ভাড়া দেয় না। যাক, ভদ্রলোক হয় খুব ভালো, নয়তো একটু বোকা। ছোটোবেলা থেকেই অনিমেষ একটু সাসপেন্স পছন্দ করে। ভদ্রলোকের কথায় স্পষ্ট একটা রহস্যের গন্ধ যেন পাচ্ছিল। সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
অনিমেষ যখন ভদ্রলোকের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত, তখন এক ফাঁকে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটি মেয়ে। বয়স খুব বেশি হলে চব্বিশ-পঁচিশ হবে। মেয়েটির মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। প্রথম দেখাতেই অনিমেষের খুব ভালো লেগে গেল। মেয়েটি দেখতেও খুবই সুন্দরী।
পরের দিন জিনিসপত্র নিয়ে অনিমেষ পৌঁছে গেল নতুন বাড়িতে। ঘরটা গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগল। তাই ক্লান্তও লাগছিল। বিছানায় শুয়ে ঘরের মধ্যে টাঙানো অয়েল পেন্টিংগুলোর দিকে তাকিয়ে খুবই আশ্চর্য হচ্ছিল। অনিমেষ একটু আধটু স্কেচ করতে পারে। তাই ওর খুব জানতে ইচ্ছে করছিল সেই শিল্পীর নাম যিনি এগুলি এঁকেছেন। সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়া করে শুতে যাওয়ার আগে তার অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। মনে হল, কে যেন জানলার বাইরে থেকে তার ওপর নজর রাখছে। দীর্ঘশ্বাসের মতো লম্বা শ্বাস ছাড়ল কেউ। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। ভাবল হতে পারে তার মনের ভুল। বাইরে হয়তো খুব জোরে বাতাস বইছে এটা তার আওয়াজ হবে। নিজেই নিজের মনকে সাহস জুগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
পরের দিন সকাল হতেই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। দেখল তার সামনে গতকালের সেই মেয়েটি, অর্থাৎ বাড়িওয়ালার সেই সুন্দরী মেয়েটি এসে উপস্থিত। মেয়েটিকে দেখে কী বলে কথা শুরু করবে, অনিমেষ ভেবে পাচ্ছিল না। তাই হঠাৎ-ই জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘ঘরের ভেতরে এই ছবিগুলো কার আঁকা? খুব সুন্দর লাগছে ছবিগুলো।’
—এ ঘরেই থাকত একজন। এখন নেই। তারই আঁকা। হেঁয়ালির সুরে বলল মেয়েটি।
—আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আপনার নামটা যদি বলেন।
—প্রিয়া।
—বাহ্, খুব সুন্দর নাম তো!
প্রিয়া-র কণ্ঠে ও চেহারায় অস্বাভাবিক কিছু আছে। চোখে চোখ রাখা বেশ কঠিন। কেমন যেন ঘোর লাগে। সম্মোহন নাকি। অনিমেষ লেখক বা কবি নয়, নয়তো প্রিয়া-র কণ্ঠস্বর, ভ্রু-ভঙ্গির নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারত। অনিমেষ আন্দাজে বুঝে নিল, প্রিয়ার সাথে এই শিল্পীর কোনও না কোনও যোগসূত্র আছে। অনিমেষের মন হঠাৎই একটু জেদি হয়ে উঠল। পুরো সত্যিটা জানতে হবে।
( ক্রমশ… )