এখন নেই মানে! ভদ্রলোক এখন কোথায় থাকেন? ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কারণ একটা কথা মানতেই হবে, উনি খুবই ভালো শিল্পী। নয়তো এমন সব ছবি আঁকা সম্ভব নয়।
—বললাম তো এখন আর তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। উনি আর ইহজগতে নেই।
—উনি কী করে মারা গেলেন? জানেন কি?
—জানি। মৃদু গলাটা একটু ঠিক করে নিয়ে বলল প্রিয়া, খুব ভালো ছবি আঁকত সে।
অনিমেষের মনে হল নিশ্চয়ই এই প্রিয়ার সাথে ওই শিল্পী ভদ্রলোকের কোনও নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পরিবার হয়তো তাতে সায় দেয়নি। শুধু তাই নয়, হয়তো ওর মা-বাবা কিছু খারাপ ব্যবহার করে থাকবে। কারণ প্রিয়ার গলায় বেশ একটা বেদনার সুর শোনা যাচ্ছিল। চোখদুটো ছল ছল করছিল।
সহানুভূতির সুরে অনিমেষ বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। ঘটনাটা আমাকে শেয়ার করতে পারেন, তাতে আপনার মনের ভার কিছুটা কমতে পারে। ভদ্রলোকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তাই তো!”
—আপনি ঠিক ধরেছেন। ওরা বলল, সন্দীপ নাকি সুইসাইড করেছে! কিন্তু আমি জানি, ও এ কাজ করতে পারে না। আমাকে ঘিরে ওর কত স্বপ্ন ছিল। বলেছিল, আমাকে নিয়ে শিগগিরই এখান থেকে চলে যাবে। অন্য কোথাও চলে যাবে। দু’জন মিলে একই ছাদের নীচে থাকব। কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না। তার প্রস্তুতিও চলছিল। হঠাৎ একদিন সকালে চা দিতে গিয়ে দেখি সন্দীপ খাটে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মুখে ফিনাইলের গন্ধ। আপনিই বলুন, ছেলেরা কখনও এত ভীতু হয় যে, ফিনাইল খেয়ে আত্মহত্যা করবে? এতটা কাপুরুষ সন্দীপ ছিল না। ওর মনের জোর ছিল অপরিসীম। আমি ওকে চিনতাম। ওরা সব ভুল বলেছে আমাকে। সন্দীপকে খুন করা হয়েছে। তারপর ফিনাইল ঢেলে দেওয়া হয়েছে ওর মুখে।
—কে মেরেছে বলে আপনার মনে হয়?
প্রিয়া ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘থাক না ওসব। শুনে কী লাভ? সব শেষ হয়ে গেছে। সন্দীপের চলে যাওয়াতে আমি শেষ হয়ে গেছি। জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রিয়া।’
অমনি অনিমেষের বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠল। এ-ই তাহলে মাঝরাতে জানলার ধারে দীর্ঘশ্বাসের আসল রহস্য।
এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা চলল। প্রিয়ার চোখ ছলছল করছে। অনিমেষ ভাবছে, এবার কি তাহলে প্রিয়া আবেগে,দুঃখে কেঁদে ফেলবে! পরক্ষণেই বুঝতে পারল যে তা নয়। এতদিনে প্রিয়া চোখের জলকে আটকাতে শিখে গেছে।
প্রিয়া নরম সুরে বলল, “এই ঘরটা আপনি ছেড়ে দিন। এই ঘর অভিশপ্ত। প্লিজ চলে যান। আপনার কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না।”
—অভিশপ্ত ঘর! আপনি এসব বিশ্বাস করেন, প্রিয়া!
—না, মানে, আমি এই ঘরে সন্দীপ ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারি না— বলেই প্রিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেল ধীর পায়ে।
অনিমেষও প্রাত্যহিক কাজ সেরে অফিসে বেরিয়ে গেল। বাইরেই ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ করে নেবে। কিন্তু মাথার মধ্যে প্রিয়ার কথাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। কী করবে ভেবে উঠতে পারছিল না।
অনিমেষ সন্ধ্যার পর বাইরে থেকে ডিনার করে বাড়ি ফিরল। কিন্তু রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারল না। শুধু দীর্ঘশ্বাস নয়, সন্দীপ এখন ফিনাইলের গন্ধটাও পেতে শুরু করেছে। ফিনাইলের ঝাঁঝালো গন্ধে গুমোট চারপাশটা।
(ক্রমশ…)