আরবি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে— ‘ইয়েম্ উস্ সফর, নিসফ্ উস্ সফর’ –অর্থাৎ কিনা যাত্রার দিনই অর্ধেক ভ্রমণ। পূর্ব বাংলায়ও একই প্রবাদ প্রচলিত আছে। সেখানে বলা হয় ‘উঠোন সমুদ্র পেরোলেই অর্ধেক মুশকিল আসান।’
‘আহমদ গাজীর উঠোন পেরোতে গিয়ে আমার পাক্কা সাতদিন লেগেছিল।’ —গল্প শুনিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর বহুচর্চিত ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে। বস্তুত মধ্যবিত্ত বাঙালির ভ্রমণের সিংহভাগ আটকে থাকে ওই উঠোন না-পেরোতে পারার বেদনায়। সামান্য ঠাঁইনাড়ার অভিলাষে জড়িয়ে থাকে প্রভূত পরিমাণ ঝক্কি এবং শেষ পর্যন্ত যা এসে দাঁড়ায় পরিমিত পকেটের কেন্দ্র বিন্দুতে।
অথচ আমরা সামান্য খরচে চাক্ষুষ করতে সক্ষম, আমাদেরই আশপাশ সংলগ্ন, সুপ্রাচীন পরম্পরা অন্বিত ঐতিহাসিক স্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনাবিল মাধূর্য। অতীতের সিঁড়ি ধরে উপস্থিত হতে পারি— অশোকের সাম্রাজ্য, জৈন তীর্থঙ্করদের ধর্মীয় আঙিনায়, গুপ্তযুগের সম্রাটদের সাম্রাজ্যে বা বৌদ্ধদের সংহত পদযাত্রায়।
কলকাতা থেকে ২৪৩ কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়া। পুরুলিয়ার সন্নিকটে দেউলঘাটা। মৃদুমন্দ বাতাস ছোঁয়া কংসাবতী নদীর ধারে সুপ্রাচীন, বিস্ময়কর জনপদের শেষ চিহ্ন। ইটের তৈরি সুউচ্চ দেউল বা মন্দির আর অনাবিল প্রকৃতির শ্যামল মুগ্ধতা একদিনেই অনুভব করা সম্ভব শুধু ‘উঠোন পেরোনো’র ঝামেলা বিসর্জন দিতে পারলেই।
বাংলার ইতিহাস অতি প্রাচীন। যে-অঞ্চলে দেউলঘাটা, প্রকৃত প্রস্তাবে সেই অঞ্চল একদা ‘বোড়াম’ নামে সুপরিচিত ছিল। দেউলঘাটা বা বোড়াম পুরুলিয়া শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে। জয়পুর ব্লক ও আড়ষা থানার অন্তর্গত দেউলঘাটায় প্রচুর দেউল অথবা মন্দির ছিল— তাই ওই অঞ্চল দেউলঘাটা নামে পরিচিতি পায়। মনে করা হয় খ্রিস্টজন্মের সাড়ে তিনহাজার বৎসরেরও পূর্বে অরণ্য ও পাহাড় অধ্যুষিত এই বিস্তৃত অঞ্চলে বৈদিক আশ্ৰমমূলক সভ্যতা এবং তা অবলম্বন করে আর্য জনপদ গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলেও হয়তো সিন্ধু সভ্যতা অথবা হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর সভ্যতার সমসাময়িক সভ্যতা বহমান ছিল।
দেউলঘাটার নিকটবর্তী গারো নদীর তীরে ইতিহাস অন্বিত সুপ্রাচীন সভ্যতার বহুনিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে। পরিব্যপ্ত সবুজ প্রান্তর, অরণ্য অধ্যুষিত, অবিচ্ছিন্ন বাতাসের কম্পনে প্রায় রিক্ত দেউলঘাটায় এখন কেবল ইতস্তত ধ্বংসাবশেষ আর স্মৃতি আঁকড়ে টিকে থাকা দুটি অনুপম মন্দির বর্তমান।
ব্রিটিশ আমলে ‘ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বক্ষণ’-এর গবেষক, জি ডি বেগলার তাঁর Report on a tour through the Bengal Provinces in 1872-73 বইতে পুরুলিয়া জেলার বোড়াম গ্রামের ইটের তৈরি মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি তিনটি মন্দিরের একত্রে অবস্থানের কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত সর্ববৃহৎ দেউলটির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন— মন্দিরের বাইরের দিকের ভাষ্কর্য বিভিন্নস্তরে সারিবদ্ধ ভাবে খাঁজ কেটে করা হয়েছে। বৌদ্ধগয়ার মতন এখানের মন্দিরে কোনও প্লাস্টারের আস্তরণ নেই। মন্দিরের প্রবেশ দরজার মাথার দিক ত্রিভূজাকৃতি। বোগলার এই বড়ো মন্দিরটিতে একটি চতুর্ভূজ দেবী মূর্তি দর্শন করেছিলেন যাকে তিনি পার্বতী বলে মনে করেছিলেন।
প্রত্নগবেষক দিলীপ কুমার গোস্বামীর বই থেকে জানা যায় ২০০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, রবিবার গভীর রাতে নদী সংলগ্ন বৃহৎ মন্দিরটি ধ্বসে যায়। সেই ধ্বংসাবশেষ অবশ্য এখনও বর্তমান। দেউলঘাটার জীবিত মন্দির দুটিই— পূর্বদুয়ারি এবং শিখর দেউল পর্যায়ের। সুব্যবস্থিত দরজার আকৃতি পঞ্চভূজ ও পিরামিডাকৃতি। গর্ভগৃহ অতিকায়। বিস্তৃত গর্ভগৃহের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের থেকেও দেয়ালের চওড়া অনেক বেশি। এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণ, মন্দির নির্মাণ হয়েছিল ইটের দ্বারা। ইটের স্থায়িত্ব কম। তাই দেয়ালকে যথাসম্ভব পুরু করা হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণ, পুরুলিয়ার আবহাওয়ায় উষ্ণতার মাত্রা অত্যধিক হওয়ায়, দেউলের অভ্যন্তর শীতল ও আরামদায়ক রাখবার অভিপ্রায়ে।
মন্দিরের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দেয়ালে তিনটি কুলুঙ্গি। মনে করা হয় কুলুঙ্গিগুলিতে দেববিগ্রহ রাখা থাকত। বর্তমানে মন্দিরে মূলত কোনও বিগ্রহ নেই। উঁচু ভিত্তিভূমির ওপরে স্থাপিত মন্দিরগুলি পঞ্চরথ আসনের। মন্দির দুটির বাহির অংশের তালজাঙ্ঘ ও উপরজাঘ দুটি স্পষ্ট ভাবে বিভাজিত। সমস্ত মন্দিরকে বেষ্টন করে উপর জাঙ্ঘের সমস্ত দেয়ালে সংকীর্ণ লহরা, এই লহরার বিস্তার কার্নিশের তলদেশ পর্যন্ত।