দেউলঘাটায় একদা প্রচুর মন্দির বা দেউল ছিল। তাই জায়গাটি আজও দেউলঘাটা নামে পরিচিত। ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এই অবহেলিত পর্যটন স্থান।
দেয়ালের চারিপাশে ঢেউ তোলা কলকার অনিন্দ্যসুন্দর বিন্যাস উপরের জাঙ্ঘকে বৈচিত্র্যময় করেছে। আপাদমস্তক কারুকার্যখচিত এই রকম মন্দিরের খুব কম দেখা পাওয়া যায়। মন্দির বিশেষজ্ঞ ড. দীপক রঞ্জন দাসের মতে, বর্তমান করুণ অবস্থা সত্ত্বেও মন্দিরটি যে আদিরূপে দক্ষিণ এশিয়ার অনুরূপ স্থাপত্যশৈলীর সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শনের অন্যতম ছিল, তা এর সংরক্ষিতাংশ দ্বারা প্রমাণিত।
দেউলঘাটা মন্দির নির্মাণে কমবেশি ২×৫ ইঞ্চি মাপের ছাড়াও আরও বিভিন্ন মাপের ইট ব্যবহার করা হয়েছিল। সর্ববৃহৎ ইটটির মাপ ছিল ১৯×৯ ইঞ্চি। গাঁথনির মশলা হিসাবে অতীব মিহি জৈব চুন ব্যবহার করা হয়েছিল। মন্দিরের অন্দর এবং বাহির দুই দিকেই ছিল অবিচ্ছিন্ন চুনের প্রলেপ। কাঁচা অবস্থায় চুনের প্রলেপের ওপরে বিভিন্ন রকমের জ্যামিতিক নকশা এঁকে মন্দিরের বহিরঙ্গ সজ্জায় যে নৈপুণ্য এবং অভিনব শিল্প-সুষমার প্রকাশ হয়েছে তা প্রাক-ইসলাম পর্বের, ইটের দ্বারা নির্মিত এই দেউলগুলিকে স্বতন্ত্র মহিমা প্রদান করেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত সর্ববৃহৎ মন্দিরটির উচ্চতা ছিল ৬০ ফুট। বর্তমান মন্দির দুটির উচ্চতা ৪৫ ফুট। মন্দিরের অভ্যন্তরে পূজায় ব্যবহৃত জল বেরিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে উত্তরমুখী মকর মুখ।
নীল আকাশ আর আদিগন্ত প্রান্তর লগ্ন দেউলঘাটার মন্দির বা দেউলগুলির সময়কাল নিয়ে গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কিছু গবেষকদের হিসেব অনুযায়ী— মন্দিরগুলির নির্মাণকাল দশম শতাব্দীর। আমরা জানি পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে বাঙালির সুপ্রাচীন কবিতা ‘চর্যাপদ’-এর সময়কাল ওই দশম শতাব্দীতেই। আবার কিছু কিছু গবেষকদের মতে- মন্দিরগুলির নির্মাণকাল একাদশ শতাব্দীর পূর্বে নয়।
দেউলঘাটা মন্দির ক্ষেত্রের মূল বৈশিষ্ট্য, অনন্য সাধারণ সুষমামণ্ডিত ভাস্কর্যর সুবিন্যাস। গবেষকদের মতে, স্বতন্ত্র এবং আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল সুঅলংকৃত ভাষ্কর্যগুলি ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রভাবিত দেব-দেবীর বিগ্রহ। সিদ্ধেশ্বর মহাদেব মন্দির রূপেই অধুনা দেউলঘাটার পরিচয় হলেও শুধুমাত্র সিদ্ধেশ্বর মহাদেব নয়, অষ্টভূজা রণচণ্ডী, চতুর্ভূজা জগদ্ধাত্রী, দশভূজা সিংহবাহিনী, চতুর্ভূজা ভৈরবী, দণ্ডায়মান গণেশ মূর্তিরও দর্শন পাওয়া যাবে দেউলঘাটায়।
দেউলের সাথে দেউলঘাটার অন্যতম আকর্ষণ কংসাবতী নদী। শীত-গ্রীষ্মে এই নদীতে তেমন জল না থাকলেও মন্দির থেকে সামান্য দূরে নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে কাচস্বচ্ছ জলে প্রবলস্রোত দৃশ্যমান। মন্দিরের অনতিদূরে সজ্জিত আশ্রম। আশ্রম থেকে নদীর ঘাটে যাওয়ার জন্য রয়েছে পাথরের সিঁড়ি। ছোটোনাগপুর মালভূমির জাবর পাহাড় থেকে উৎপত্তি দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান নদী কংসাবতীর। কালিদাসের মেঘদূতে যা কাপিশা নামে প্রাধান্য পেয়েছে।
পৌষ সংক্রান্তিতে বিশাল মকরমেলা হয় দেউলঘাটায়। এছাড়া চৈত্র মাসে দোলের পরে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে হয় বারুণী মেলা। দেউলঘাটা আজও কালস্রোতে ভেসে যাওয়া প্রায় অবহেলিত, অনাদরে উপেক্ষিত এক প্রাচীন জনপদ। এখানে রাত্রিযাপনের কোনও সুব্যবস্থা নেই। ভ্রমণ পিপাসুরা অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণের সঙ্গে দেউলঘাটা বেড়িয়ে নিতে পারেন।
বিভিন্ন রাজা ও সাধু-সন্ন্যাসীদের জনশ্রুতি ও উন্নত জীবনচর্চার কৌলিন্যে বহুযুগ পূর্বেই পুরুলিয়া পূর্ব ভারতে হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয় জনপদ। তৎকালীন পুরুলিয়ার মানুষদের দ্বারা নির্মিত সৃজনশীল ভাষ্কর্য যে কতটা নয়নমুগ্ধকর এবং বিস্ময়কর ছিল— তা অনুধাবন করা সম্ভব হবে একবার দেউলঘাটা দর্শন করলেই।
কীভাবে যাবেন : হাওড়া স্টেশন থেকে পুরুলিয়া যাওয়ার প্রচুর লোকাল ও মেল-এক্সপ্রেস ট্রেন রয়েছে। আগের থেকে রিজার্ভেশন করে নেওয়াই সুবিধে।
পুরলিয়া স্টেশন থেকে প্রাইভেট গাড়িতে দেউলঘাটা দেখে সেই দিনই পুরুলিয়া ফিরে আসা যায়। ভাড়া মোটামুটি ১৮০০ টাকা। এছাড়া পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে জয়পুর হয়ে বাস যায় দেউলঘাটা। মনে রাখবেন, দেউলঘাটায় রাত্রিযাপনের সুবন্দোবস্ত নেই। এসবিএসটিসি বা প্রাইভেট বাসেও পুরুলিয়া যাওয়া যায়। বাস ছাড়ে ধর্মতলা থেকে।
কোথায় থাকবেন : প্রচুর হোটেল ও ধর্মশালা রয়েছে পুরুলিয়ায়। তবে হোটেলে থাকাই ভালো। ১০০০ টাকার মধ্যে ডাবল বেডেড রুম পাওয়া সম্ভব। এছাড়া, হোটেলের মর্যাদার ওপরে আরও বিলাসবহুল, দামি হোটেলও পাওয়া যায়।