আজকাল ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে মানুষ নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। যারা নিজেরা ঠিক করে নিচ্ছে, সেই ছেলেমেয়েদের গল্প এখানে নয়। এখানে তাদের নিয়ে গল্প যারা সুবোধ ছেলে বা মেয়েটির মতো পাত্রী বা পাত্র নির্বাচনের দায় বাবা-মার হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

সম্বন্ধ আনা এবং বিয়ে করিয়ে দেওয়া কাজটি বড়োই কঠিন। সফল হলেও একটা কিন্তু লোক লাগিয়েই দেবে। আর বিফল হলে তার গুষ্টির তুষ্টি একদিন দু’দিন নয়, দীর্ঘদিন চলবে। আজকাল এই কাজটা কিছু ব্যবসায়ী সংস্থা হাতে নিয়েছে। তাতে হতাশ হয়ে ফিরে আসার লাইন অবশ্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

আগেকার দিনে ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে পাত্রের বাড়ির থেকে দল বেঁধে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতো। এটা ছিল এক সম্মানজনক প্রতিনিধিত্ব। মনে যাই থাকুক না কেন ভাবটা থাকত- – মশাই আপনার ঘাড়ের বোঝা কমাতে এলাম, নির্ভর করছে আপনার কৃতকর্মের উপর। তাতে ছেলের বাবা-মা ছাড়া থাকত পরিবারের বা বন্ধুবর্গের মধ্যের একজন বিচক্ষণ ব্যাক্তি।

গুষ্টিশুদ্ধ নিয়ে এসেও নীতিবাগীশ পাত্রপক্ষের বয়ঃজ্যেষ্ঠর কড়া নির্দেশ আসত— কন্যা পছন্দ না হলে সেই বাড়ির অন্ন ধ্বংস করা অনুচিত হবে। কিন্তু এটা ভুলে যেত পাড়ার মিষ্টির দোকানদার, মিষ্টি আর ফেরত নেবে না। সব ক্ষেত্রে এই আদেশ অবশ্য কার্যকারী হতো না। বিশেষ করে খাদ্যরসিক পেটমোটা পিসেমশাই যদি থাকতেন।

মেয়ে পাত্রপক্ষের পছন্দ হলে, সবচেয়ে আগে বদলে যেত পাত্রীর বাবার শারীরিক ভঙ্গিভাবটা, খুব সস্তায় ভালো মাল ছেড়ে দেওয়া ব্যাপারীর মতন।

আমার মা যেচে পড়ে অনেক সমাজসেবা করতেন। প্রায়ই আবেগমথিত হয়ে পরোপকারিকতার ভূত মাথায় চাগাড় দিত। পাড়ার এক অতি ফোঁড়ে লোক কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে যেতেন, আর তার খেসারত দিতেন ওনার স্ত্রী। বেচারিকে প্রচুর টিউশন পড়িয়ে কোনওমতে সংসারের হাল ধরতে হতো। ঘরে চার চারটি অবিবাহিত মেয়ে। খুব নিরীহ এক পুরোহিতমশাই আসেন তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য বড়ো মেয়েটিকে নির্বাচন করতে। সমাজসেবার অঙ্গ হিসেবে আমার মা সম্বন্ধটা এনেছিলেন।

মাড়োয়ারিদের বাড়িতে জজমানি করে পুরোহিতমশাই ভালোই উপার্জন করেন। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে নিজের সাদামাটা পাকা বাড়িতে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। পত্নি অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। ছেলেকে কাপড়ের দোকান খুলে দিয়েছেন বেহালা চৌরাস্তায়। মেয়েটি ক্লাস সিক্সের বেড়াও ডিঙোতে পারেনি। দেখতেও সাদামাটা, তবে মনটা খুব ভালো। এর আগে অনেক সম্বন্ধ এসেছে ও গেছে। এহেন পাত্রীকে ছেলের বউ হিসাবে পছন্দ করার পর পুরোহিতমশাই যারপরনাই বিপদের সামনে পড়লেন।

পাত্রীর বাবা হঠাৎ করে তাঁকে ইংরেজিতে ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করেন। বেচারা পুরোহিত তখন সবে পাত্রী নির্বাচন করে রসগোল্লার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। রসগোল্লা হাতে নিয়ে তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাত্রীর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি করলেন, ‘আপনি কী কন বুঝি না আমি।’ আমার মাতৃদেবী দেখলেন হাতে পাওয়া সাফল্য ছিটকে গেল বলে! সাকসেস রেট নীচে চলে যাবে… ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি সামলে দিয়ে ডিল পাকা করলেন।

আমার এক পিসি ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে ছেলের উপর রাগ করে উঠে এসেছিলেন এই বলে, “তুই এক কাজ কর একটা বরমালা এনে এখনই পরিয়ে দে, আমি চললাম।’

ভাইটি খুব অল্প বয়সে চাকরি নিয়ে বাইরে যায়, হাত পুড়িয়ে খায়। বেচারার আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছিল না। না পারত সন্ধ্যাবেলার পার্টিতে বসতে। চাকরি পাওয়ার আট বছর বাদে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ভাইটির মা দু’বছর ধরে ছত্রিশটি পাত্রী দেখেছেন, আর সব ক’টা না করার অকাট্য যুক্তি দিয়ে সম্বন্ধ বানচাল করেছেন।

এই প্রথম ভাইটি নিজে গেছিল দেখতে। পাত্রী দেখতে ভালো, বাড়িঘর ভালো, পড়াশোনাতেও মন্দ নয়। আট মাস বাদে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। আর এইখানেতেই বাঁধল মুশকিল।

মা বললেন, ‘পরীক্ষাটা দিয়ে পাস করে নিক, তারপরে পাকা কথা হবে।’ ছেলে দেখল সমূহ বিপদ, আবার একটা অজুহাত মা পেয়ে গেছে।

ছেলের মাসি মেয়ে দেখতে এসে ছেলেকে আড়ালে ডেকে বলেছিলেন, “শোনো বাবু, যদি সারাজীবন ব্যাচেলর না থাকতে চাও, নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজেই নিও।’

বাবু ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘পরীক্ষা হতে এখন অনেক দেরি। বিয়ের পর অনেক সময় পাবে।’ ব্যস, এতেই আগুনে ঘি পড়ল।

—আমি থাকতে এত বড়ো কথা। তোর বিয়ে তুই কর, বলে আমার পিসি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যান। বিয়ে সেই পাত্রীর সাথেই হয়েছিল এবং একমাসের মধ্যে। ছেলের জেদের কাছে হার মেনে মা অবশেষে রণে ভঙ্গ দেন।

এবার শোনাই আমার এক মাসতুতো শ্যালিকার মুখ থেকে শোনা গল্প। মাসতুতো শ্যালিকার ছিল এক বিধবা পিসিমা। পিসিমা এক ছেলে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হন। জীবনের অনেক ঝড় ঝাপটা একাই সামলে ছেলেকে মানুষ করেন। ছেলে বিখ্যাত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। যাদবপুরে কচুরিপানা ভর্তি জমি রাত জেগে জবরদখল করে তার উপর বাড়ি তুলেছেন পিসিমা। সেই জায়গা এখন উঠতি বনেদি পাড়া, আর সেই টালির চালের বাড়ি এখন তিন তলা আলিশান অট্টালিকা। পিসিমা কর্পোরেশন স্কুলে চাকরি করেন। এইমত অবস্থায় উপযুক্ত পাত্রর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলেন পিসিমা।

পিসিমার আপন বলতে দাদা, বউদি আর ভাইঝি। যেখানেই পিসিমা পাত্রী দেখতে যান, সাথে যান দাদা, বউদি ও ভাইঝি। জীবন যুদ্ধে প্রচুর লড়াই করে পিসিমার রসবোধ কমে কথাবার্তায় বেপরোয়া ভাব এসে গেছিল। মেয়ে দেখা হয়েছে, মেয়ে পছন্দও হয়েছে। ঠিক হল এবার ছেলে এসে দেখলেই বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...