পিসিমা হাই সুগারের রুগি, তাই মিষ্টি খাওয়া একেবারে মানা। এটা শুনে পাত্রীর বাবা দৌড়ে গিয়ে পাড়ার হরি ময়রার দোকানের বিখ্যাত হিংয়ের কচুরী নিয়ে এলেন। লোভে পড়ে পিসিমার দ্বারা গোটা পাঁচেক কচুরী সাবাড়। আর তারপরই শুরু হল পিসিমার পেটে মোচড় দেওয়া। সে ভয়ংকর মোচড়, কোনও বাধা মানতে চায় না। পিসিমা প্রমাদ গুনলেন।
পিঠ সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের বাথরুমটা কোথায় দেখান। আর একটা গামছা দেন আমারে।” পিসিমার ভাইঝি অর্থাৎ আমার শ্যালিকা পিসিমার এই কাণ্ড দেখে লজ্জায় মরে যায় আর কী। এরপর ওই বিবাহের প্রস্তাবের গাড়ি সে যে কারণেই হোক বেশি দূর এগোয়নি। শ্যালিকাও পিসিমার সাথে আর কোনও পাত্রী দেখতে যায়নি।
আমার এক খুড়শ্বশুর ভীষণ রসিক মানুষ। এবার শোনাই ওনার মুখে শোনা গল্প। আগেকার দিনে কিছু ছেলে থাকত ভীষণ লাজুক। বাবা মাকে বলত, ‘মেয়ে তোমরাই দেখে পছন্দ করো। আমার যাওয়ার দরকার নেই।”
জলপাইগুড়িতে এরকমই একটি ছেলে আমার খুড়শ্বশুরের বন্ধু, তার সম্বন্ধ এল জলপাইগুড়ির এক বিত্তশালী পরিবার থেকে। ছেলেটি দিল্লিতে চাকরি করে। বাড়িতে আসবে বিয়ের আগে। বাবা, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে গিয়ে প্রচুর ধারদেনা করেছেন। দেনা তখনও সব মিটিয়ে উঠতে পারেননি। ছেলে এসে বিয়ের আগে বন্ধুদের আড্ডাতে পৌঁছল। বন্ধুদের মধ্যে ফিসফিসানি! এক বন্ধু বলেই ফেলল, “হ্যাঁ রে তুই মেয়ে দেখেছিস!”
ছেলে বলল, “ওসব বাবা-মা সেরেছেন। ওনাদের পছন্দ ই আমার পছন্দ।”
এরপর ছেলে বহুবন্ধু পরিবৃত হয়ে টোপর পরে ছাদনাতলায় উপস্থিত হল। কনে এল পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে জামাইবাবুদের ধরা পিঁড়িতে চড়ে। ঘনিয়ে এল শুভদৃষ্টির সময়। মুখের সামনে থেকে হাতের পান সরল। ছেলে অতি আকাঙ্ক্ষিত দর্শনের পরই আমার খুড়শ্বশুরের কাঁধে মাথা দিয়ে জ্ঞান হারাল।
কনের সামনের দিকের তিনটি দাঁত বিসদৃশ ভাবে উঁচু হয়ে ছিল। তখনকার দিনে উঁচু দাঁত নীচু করে স্বাভাবিক করার চিকিৎসা আসেনি। সব শোনার পর খুড়শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তারপর।ত
উনি বললেন, ‘তারপর আর কী! জ্ঞান ফিরতে ওই বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরেছিল। বিয়ের জন্য মেয়ের বাবার থেকে অনেক টাকা পণ নিয়েছিলেন ছেলের বাবা। ধমকে ছেলেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসালেন।”
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর!’
শ্বশুরমশাই বললেন, ‘তারপর আর কী, তিনটে বাচ্চা হল। সব ঠিক হয়ে গেল।”
এর বেশি আর ‘তারপর শ্বশুরমশাইকে জিজ্ঞেস করা যায় না। তার উপর রসিকবাচন পারদর্শী শ্বশুরমশাই।
এক আত্মীয়র আন্দামানে মারাঠি মেয়ের সাথে প্রেম হয়। মেয়েটি বাংলা ভাষা খুব তাড়াতাড়ি ভালোরকম শিখে ফেলে। এতে অবশ্য তার বাঙালি প্রেমিকেরও অবদান ছিল। বিয়ের আগে মেয়ের বাড়িতে এসে মেয়েটির ভবিষ্যতের নন্দাই মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘গুঁতোর মানে জানেন’
স্মার্ট উত্তর দেয়, ‘একটু এদিকে আসলেই বুঝিয়ে দিতে পারব।’
নন্দাইমশাই উত্তর দেন, ‘যাওয়ার দরকার নেই, বুঝেছি বাংলা শেখা অনেক দূর এগিয়েছে।”
মেয়ে দেখতে আসার আগে কমজোর মেয়েদের আগে ভালো করে ট্রেনিং দেওয়া হতো। প্রথম সতর্কবাণী, বেশি কথা বলবে না। দ্বিতীয় সতর্কবাণী, আজ অন্তত লাজুক ভাবে বসে থাকবে। তৃতীয় সতর্কবাণী, গুরুজন সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। ঠাকুমার মুখে শুনেছি কোনও একটি মেয়েকে পছন্দ হওয়ার পর সম্বন্ধ ভেঙে যায়। কারণ বেরনোর সময় মেয়েটির কথায় নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ হওয়াতে।
মেয়েটি দরজায় দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে বলেছিল, ‘এখানে সম্বন্ধ পাকা না হলেও আপনারা আবার আসবেন।’ কথাটা খারাপ কিছুই বলেনি, লোকজন খারাপ ভাবে নিয়ে নেয়।
আর আরেক জায়গায় পাত্রী অতিরিক্ত মাথা নীচু করে প্রণাম করতে করতে পাত্রপক্ষের সাথে বসে থাকা নিজের ছোটো বোনকেও প্রণাম করে ফেলেছিল।
আমার এক পরিচিতা সাত তাড়াতাড়ি বিয়ের পিড়িতে বসবে না বলে জেদ করে কোনও মেক-আপ ছাড়াই, হাওয়াই চটি পরে, গায়ে কালো শাল জড়িয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গিমাতে পাত্রপক্ষের সামনে এসে বসে। সেই পরিচিতা যথেষ্ট সুন্দরী এবং ভালো মনের মেয়ে ছিল। জহুরির চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে। পাত্র বাবা-মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই মেয়েকে ওখানেই পছন্দ করে জানিয়ে দেয়। পরবর্তী জীবনে শ্বশুরবাড়িতে পুরো পরিবারের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠে মেয়েটি।
আগেকার দিনে মেয়ে গান গাইতে জানে কিনা সেটা সবচেয়ে আগে জিজ্ঞেস করা হতো। একটু আধটু গান গাইতে জানলেই চলত। মোটা মেয়ে হলে গান ধরত— আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে… আর তারপর আমার এই দেহ খানি তুলে ধর…।
আর কালো মেয়ে গাইত আপনারা ভাবছেন— কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, মোটেই না। আগ বাড়িয়ে নিজের উইক পয়েন্টের ঢাক কেউ পেটায় নাকি?
একটু বিনয়ী কালো মেয়েরা গাইত— তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে/ তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে। অর্থাৎ আমি যেরকমই দেখতে হই না কেন, তুমি তোমার অন্তরের মহানুভবতা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।
আবার একটু উদ্ধত কালো মেয়েরা গাইত — আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব / আমি হাত দিয়ে দ্বার খোলাব না, গান দিয়ে দ্বার খোলাব।
শেষ করি একটি মিষ্টি প্রেমের মিষ্টি পরিণতি দিয়ে। একই পাড়াতে থাকত একটি সুদর্শন ছেলে এবং অতি সুন্দরী একটি মেয়ে। দুজনেরই দু’জনকে খুব ভালো লাগত। আসতে যেতে একজন আরেকজনের দিকে না তাকিয়ে পারত না। দু’জনে সমবয়সি ছিল। ছেলেটি ভীষণ লাজুক, মেয়েটিকে গুছিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটির সম্বন্ধ দেখে দিল্লিতে বিয়ে হয়ে গেল।
এরপর কর্মসূত্রে ছেলেটিও দিল্লি চলে যায়। সংসার হয় এবং পাকাপাকি ভাবে দিল্লিবাসী হয়ে যায়। এর অনেক দিন পর নিজের বিবাহযোগ্য ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে দিল্লিতে সেই মেয়েটির বাড়িতেই পৌঁছোয় ছেলেটি পাত্রর বাবা হয়ে। আর পাত্রী ছিল অল্প বয়সের প্রেম নিবেদন করতে না পারা সেই মেয়েটিরই কন্যা। এক দেখাতেই বিয়ে পাকা।
সবার আগে লাফিয়ে পড়ে ছেলের বাবা মেয়ে পছন্দ হওয়ার সম্মতি জানিয়ে দিল। দুজনেই সযত্নে এড়িয়ে গেল নিজেদের পূর্ব পরিচয়ের ঠিকানা। আইনি জীবনসঙ্গী হিসেবে জীবনে পাওয়ার প্রাপ্তি অপূর্ণ থাকলেও, ‘বেয়াইন’ হিসেবে প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার প্রাপ্তির মূল্য কম কীসে?