শৈশবের পৃথিবীটা আমাদের কাছে একটু অন্যরকমই ছিল। ঠিক যেন মিহি সুতোয় বোনা বিচিত্র ফুলতোলা নকশার মতো। পায়ের তলার মাটি, গাছপালা, মাথার উপর আকাশ সবই রয়েছে আগের মতোই, কিন্তু না! এখন কেমন যেন সবটুকু হারিয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়।

কালবৈশাখী ঝড়ের পর প্রথম বৃষ্টির ফোঁটায়, ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ আর অনুভব করতে পারি না। এক বুক নিঃশ্বাস নিলেও কুয়াশায় ছাওয়া শীতের সকালে ভেজা ঘাসের গন্ধ আর আগের মতো টের পাই না। সন্ধেবেলায় মা নিজের হাতে পরিপাটি করে নিকোনো মাটির উনুনে আঁচ দিলে, উনুনের সেই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে যেত। সেই ধোঁয়ার অদ্ভুত একটা গন্ধ আমাকে কতবার ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে।

কিছু গন্ধ এখনও অনুভূত হলে তা আজও টেনে নিয়ে যায় সেই ছোট্টবেলায়। যেমন, মায়ের গায়ের গন্ধ আজও লেগে আছে আমার সারা শরীরে-মনে। সব কাজ সেরে অনেক রাতে মা যখন বিছানায় আসত, তখন ঘুমের মধ্যেও মায়ের অস্তিত্ব টের পেয়েই মায়ের দিকে ফিরে শুতাম। শীতকালে পয়লা গুড় আর পুলি-পিঠের গন্ধ, আহঃ! বছর শেষে নতুন ক্লাসে নতুন বইয়ের পাতায় পাতায় জমে থাকা গন্ধ সে কি ভোলা যায়!

শৈশবের কথা মনে আসলেই মনের কোণে জমে থাকা অজস্র স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যাই। মনে পড়ে বর্ষাকালে কাপড় টাঙিয়ে অন্ধকার ঘরে ভূত ভূত খেলতাম। কিন্তু সন্ধে হলেই ভূতের ভয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে পা সরত না। জানি না কী ছিল সেই শৈশবে! তবে, অফুরন্ত প্রাণচাঞ্চল্য ছিল আমাদের মধ্যে।

তখন ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট এত আলো ঝলমলে ছিল না। সন্ধে নামলেই অন্ধকার ঘিরে ধরত। হলুদ বাল্বের টিমটিমে আলোয় কোনওরকমে রাতটা কেটে গেলে ভোর হতে না হতেই, ঘুম ভাঙা চোখে ছুটে বাইরে চলে আসতাম। ততক্ষণে সাজি হাতে সঙ্গী-সাথিরা সকলে এসে হাজির হতো ফুল তুলতে যাওয়ার জন্যে। ভোরের আকাশ দেখে ঘোর বিস্ময় লাগত। উদিত রবির কিরণে রাঙা হয়ে উঠছে পুবদিক! কত পাখি ডাকছে! কত ফুল ফুটেছে!

বড়ো হবার পর কখনও কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হতো গতকাল সকালে কি সবকিছু ঠিক এমনই ছিল! কি জানি! তবে কিছু ঠিক থাকুক আর নাই থাকুক, সীমাহীন আনন্দ ছিল।

আমরা গুটিকয়েক ভাইবোন, তার সঙ্গে পাড়ার ছেলেমেয়ের দল এসে জুটত আমাদের বাড়িতে। সারাদিন হইচই, খেলাধুলা লাফঝাঁপ— কিছুর কমতি ছিল না। কিন্তু সেই আনন্দময় ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে একটা দুঃখের ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। আচমকা আমার মেজদার মৃত্যু! মেজদার নাম ছিল অনুপম। মা ডাকত অপু বলে। ছোটোবেলার সেই ঘটনাটা ভাবলে আজও মুচড়ে ওঠে বুকের ভেতরটা।

ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন আমি খুবই ছোটো। আমার বাবা, বড়দা ও মেজদার জোড়া উপনয়নের আয়োজন করেছিলেন। সেই উপনয়ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে আমাদের উচ্ছলতা এবং উচ্ছ্বাসের শেষ ছিল না। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শনিবার অনুষ্ঠান হবে বাড়িতে। মা-বাবা ব্যস্ত অতিথি নিমন্ত্রণ, বাজার দোকান এবং উপনয়নের বিভিন্ন আয়োজনের ব্যবস্থাপনায়৷

অভিশপ্ত সেই দিনটা ছিল মঙ্গলবার। সন্ধেবেলা দিম্মা আর মেজো মাসি আসবে শুনে আমাদের আনন্দ আরও দ্বিগুন হয়ে উঠেছে। দিম্মা আসা মানেই আমাদের ‘পোয়া বারো’। বড়দা তখন সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে, কাজেই কলেজে তাকে যেতেই হবে। শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী উপনয়নের পর তিনদিন ওদের দু’জনকে দণ্ডিঘরে থাকতে হবে। তারপর আত্মীয়স্বজন চলে গেলে তবে বাড়ি স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে। আমরা ছোটোরা তো মহা আনন্দে আছি। স্কুলে যেতে হবে না! পড়তে বসতে হবে না! এই ক’দিন শুধুই আনন্দ আর আনন্দ।

দুপুর শেষে আমাদেরকে বাড়ির ভেতরে রেখে, বাইরে থেকে খিড়কি দরজায় শিকল তুলে দিয়ে, মা পাশের বাড়িতে গিয়েছিলেন ঘর-যগ্যির বাসন আনতে। তখন তো বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশনের মতো সব অনুষ্ঠানগুলো বাড়িতেই হতো। অন্তত তিন-চার দিন আগে থেকেই খুব নিকট আত্মীয়রা চলে আসতেন অনুষ্ঠানের আয়োজনে সহযোগিতা করার জন্যে।

আমাদের বাড়ির বাগানে আম, জাম, কাঁঠাল গাছের সঙ্গে একটা লিচুগাছও ছিল। এইসময় লাল লাল লিচুতে ভর্তি হয়ে যেত গাছটা। সকলেরই নজর পড়ত গাছটার দিকে।

মা পাশের বাড়িতে চলে যাবার পরেই মেজদা আর সেজদা খিড়কি দরজা বেয়ে পাঁচিল পেরিয়ে সোজা গিয়ে উঠল লিচুগাছে। পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখতে পেয়ে মা বারণ করতেই ওরা নেমে এসেছিল গাছ থেকে। কিন্তু মা বারান্দা থেকে সরে যেতেই আবার গিয়ে গাছে উঠে পড়েছিল। সেইসময় মেজদি ছোড়দি ঘরের ভেতরে ছিল আর আমরা ছোটো দুই ভাইবোন বাড়ির উঠোনে বসে দেখছি, ওরা গাছ থেকে নামছে আর উঠছে। পাঁচিলে উঠতে যাবার সময় সেজদা আমার মাথায় টোকা মেরে বলেছিল— মাকে বলে দিলে কিন্তু একটাও লিচু পাবি না! আমি শুধু মাথা নেড়েছিলাম।

দুইভাই মনের সুখে লিচু ছিঁড়ছে আর ব্যাগে ভরছে। আচমকা ভীষণ জোরে মড় মড় করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ হল। সেই বিকট শব্দ আর সেজদার চিৎকারে সকলে ছুটে এসে দেখে ডাল ভেঙে মেজদা পড়ে গিয়েছে। গাছের নীচে একটা সরু শুকনো নালি ছিল। তার মধ্যে মেজদার মাথাটা আটকে গিয়েছে। আর বাকি শরীরটা নালির বাইরে উঁচু হয়ে উঠে রয়েছে। সবাই এসে কোনও মতে মাথাটা টেনে বার করে মেজদাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় সেজদা হতচকিত হয়ে পড়েছিল।

আমার বেশ মনে আছে, সময়টা ছিল কালবৈশাখীর। সহসা নির্মেঘ আকাশে দুর্যোগ ঘনিয়ে এল। সারা আকাশ কালো করে কালবৈশাখী ঝড় উঠল। চারিদিক ধুলোয় ধুলো। গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছে, টালির চাল উপড়ে যাচ্ছে, সেইসঙ্গে বাঁধভাঙা বৃষ্টিও শুরু হয়েছিল অঝোর ধারায়।

বাবা দুপুরে বেরিয়েছিলেন শুভ উপনয়নের আচার-উপচার সম্বলিত পুরোহিতের দেওয়া তালিকা নিয়ে। আয়োজনে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। লিচুগাছ থেকে মেজদার পড়ে যাওয়ার খবর মুহূর্তে ঝড়ের বেগে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বাবা খবর পাওয়া মাত্রই বাজার দোকান সব ফেলে দিয়ে ঝড় মাথায় নিয়ে বাড়িতে চলে এল।

একটু পরে মেজদা বমি করতে শুরু করল। মা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়ে কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। তখনও মেজদা শান্ত অস্ফুট স্বরে বলে চলেছে, ‘মা তুমি চিন্তা কোরো না, আমার কিচ্ছু হয়নি। এখনই ঠিক হয়ে যাবে…’

এদিকে ঝড়- -বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই। হ্যারিকেনের আলো আর ঘন ঘন বিদ্যুতের চমকে হঠাৎই যেন ভয়ংকর চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছিল সন্ধেটা। ভয়ে সিঁটিয়ে বসেছি আমরা ছোটো দুই ভাইবোন। প্রতিবেশী কাকিমা জেঠিমারাও এসেছেন। সামাল দিতে পারছে না কেউই। মেজদা আরও দু’বার বমি করল। বাবা ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই পাশের বাড়ির জেঠুকে নিয়ে ওদের জিপ গাড়ি করে বেরিয়েছেন ডাক্তার আনতে। সকলেই উতলা হয়ে উঠেছে কতক্ষণে ডাক্তার আসবে! রাস্তায় গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে, সেইসঙ্গে ইলেক্ট্রিকের তারও ছিঁড়ে পড়ে আছে। সবরকম যানবাহন চলাচল বন্ধ।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...