কোটায় ১৫ থেকে ২২ বছর বয়সি প্রায় ২ লক্ষ তরুণ-তরুণী প্রতি বছর পড়তে যায় বাবা-মায়ের প্রচুর অর্থব্যয়ের বিনিময়ে। জেইই, নিট, আইএএস-এর মতো বহু পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যই কোটার প্রসিদ্ধি, যাতে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তথাকথিত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে।
মা-বাবারা তাদের উচ্চাশার সোপান করে সন্তানের পঠন-পাঠনের জন্য এই ব্যয়ভার বহন করেন— কখনও আধপেটা খেয়ে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে বা কখনও জমি বাড়ি বিক্রি করে। উদ্দেশ্য একটাই— সন্তান যাতে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাবা-মা তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারেন। কোটায় প্রস্তুতিমূলক পঠন-পাঠনের সময় কেউ কেউ আবার মা-কেও সঙ্গে নিয়ে যায় যাতে পড়াশোনা চলাকালীন বাড়ির খাবার খাওয়ার সুবিধাও মেলে।
আমাদের দেশের যা জনসংখ্যা সেই অনুপাতে যত তরুণ তরুণী দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়, তাদের পরবর্তী পড়াশোনা চালানোর মতো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এদেশে নেই। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার মান নেমে আসায়, সাধারণ মানুষ এগুলি থেকে মুখ ঘুরিয়ে, বেসরকারি দামি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
প্রতি বছর দ্বাদশ উত্তীর্ণর সংখ্যাটা ১ কোটিরও বেশি। ২০২২-এ সংখ্যাটা ছিল ১ কোটি ৪৩ লক্ষ যার মধ্যে ১ কোটি ২৪ লক্ষ ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়।
এই বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়েকে পঠন-পাঠনে সুযোগ দেওয়ার মতো ইনফ্রাস্ট্রাকচার সরকারের নেই। সরকারি মেডিকেল কলেজে তাই সিটের সংখ্যা মাত্র ৮,৫০০ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কিন্তু ৪৭,৪১৫টি সিট থাকে এবং খরচও সেখানে আকাশছোঁয়া। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ১৫,৫৩,৮০৯টি সিট কিন্তু আইআইটি-র মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১০,০০০-১২,০০০ সিট।
সরকারি আর্টস কলেজে তো আরওই খারাপ অবস্থা। সেখানে অর্ধেক দিন ছুটি, বাকি অর্ধেক দিন শিক্ষক অনুপস্থিত। এই যেখানে অবস্থা সেখানে কোচিং ইন্সটিটিউট তো রমরমিয়ে উঠবেই। মা-বাবারা সরকারি ব্যর্থতার শিকার। যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি সঠিক পরিকাঠামো প্রদান করে তাহলে তার জন্য মোটা ফিজ-ও দিতে হবে পড়ুয়াদের। জেইই, নিট, ইউপিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলেই, সফল ছাত্রদের ছবিতে ভরে যায় সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনী পাতা। মা-বাবারাও সেসব দেখে প্রভাবিত হয়ে তাদের সন্তানের জন্য এই সব প্রতিষ্ঠানে কোচিং করাতে উদ্যোগী হন।
দেশের ধনীদের জন্য রাজপথ তৈরি হবে, যেখানে ২০ লক্ষ টাকার গাড়ি চলবে কিন্তু গরিব মা-বাবার মেধাবী সন্তান সুযোগের অভাবে দিনমজুর হয়ে দিন কাটাবে— এটাই এদেশের রীতি।
মা-বাবাদের দোষ দেওয়া যায় না। তারা নিজেদের এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে যদি সৰ্বস্ব দিয়ে তাদের শিক্ষায় ব্যয় করেন এবং কৃতকার্য হতে না পারার শ্লাঘায় সন্তান যদি আত্মহত্যা করে— তাহলে আখেরে দোষ কার?