ঝরনার বয়স ১১। ওকে অনেকদিন পর বারান্দায় আসতে দেখে উলটো দিকের ফ্ল্যাটের চৌধুরিদের বড়ো মেয়ে দৃষ্টি জিজ্ঞেস করল, ‘ঝরনা অনেক দিন পর তোমাকে দেখছি, এখানে ছিলে না?’
ঝরনা উত্তর দিল, ‘এখানেই ছিলাম, কোথাও যাইনি। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত স্কুল, টিউশন, স্কুল আর টিউশনের হোমওয়ার্ক, বন্ধুদের ফোন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ততার কারণে বাইরে বেরোবার সময় পাই না।’
ঝরনার উত্তর শুনে দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল নতুন এই সমাজ ব্যবস্থায় পুষ্ট হয়ে ওঠা হিউমান রোবটের দৈনন্দিন জীবনের নতুন একটা রূপ।
এই ঘটনা দক্ষিণ কলকতার হলেও আজ সমস্যা প্রতিটি শহরের টিনএজারদের জন্য প্রায় একইরকম। ব্যস্ত জীবনশৈলীর কারণে আজকের ছেলেমেয়েরা একটা স্পেসিফিক জীবনচর্যায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। শৈশবেই বাড়ি, পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোনের থেকে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে তারা নিজের মধ্যেই গড়ে তুলছে বিচ্ছিন্ন এবং একক জীবন।
২০১৬-তে দিল্লির একটা স্কুলের ঘটনা আজও বাকরুদ্ধ করে দেওয়ার মতো। এগারো ক্লাসের এক ছাত্র ৭ বছরের প্রদ্যুমন-কে হত্যা করে শুধুমাত্র পরীক্ষা এবং পিটিএম মিটিং থেকে বাঁচার জন্য। পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষার ভয়, পিটিএম-এ শিক্ষক এবং অভিভাবকদের থেকে ভর্ৎসনার আশঙ্কা ওই ছাত্রকে মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত করেছিল যে, সে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
২০১৯-এ সারা বিশ্বে কোভিড অতিমারি ছড়িয়ে পড়লে চারদিকে হাহাকার পড়ে যায়। ইউনিসেফ-এর একটি সমীক্ষা অনুসারে ভারতে প্রায় ৩৩০ মিলিয়ন শিশু মানসিক ভাবে কোভিড দ্বারা প্রভাবিত হয়। টোটাল লকডাউন এবং কোভিডের বাড়বাড়ন্ত মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়, পাবলিক প্লেসে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। বাচ্চাদের পড়াশোনাও অনলাইন নির্ভর হয়ে ওঠে।
সব ক্ষেত্রেই মানুষের রিয়েল ওয়ার্ল্ড-এর সঙ্গে সম্পর্ক ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। বাড়ির ভিতরের অন্দরমহল-ই বাস্তব হয়ে ওঠে সকলের জন্য। খেলনার জায়গা অধিকার করে মোবাইল এবং মানুষের উপর সোশ্যাল মিডিয়ার থাবা ক্রমশ গভীরতর হয়ে ওঠে।
একটি সমীক্ষা অনুসারে ভারতে ইন্টারনেট ইউজারের সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি যার মধ্যে ৫ থেকে ১৫ বছরের বাচ্চাও রয়েছে। এখানে জনসাধারণ প্রায় পাঁচ ঘন্টা ফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ব্যস্ত জীবনশৈলীর কারণে মানুষ সামাজিক স্তরে একাকিত্ব ভোগ করছে এবং মানসিক যাতনাও ভোগ করছে। একাকিত্বের প্রভাব এতটাই যে কৈশোরেই ক্রিমানাল অ্যাক্টিভিটি-তেও অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে। কোভিড ও লকডাউনের পরিস্থিতি চলাকালীন বাচ্চারাও ইন্ট্রোভার্ট হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে।