শহুরে সভ্যতায় ক্রমশ একটা নতুন ট্রেন্ড মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে যে, কে নিজের বাচ্চাকে সবথেকে বেশি ফেসিলিটি দিতে পারে তাই নিয়ে প্রতিযোগিতার মানসিকতা। বাস্তবে এই ফেসিলিটির অর্থ, বাচ্চাকে কতটা ব্যস্ত রাখা যায়। যার বাচ্চা যতটা ব্যস্ত, ভবিষ্যতে সে ততটাই উপযুক্ত— এমনটাই এ যুগের ধারণা। এই মানসিকতারই প্রতিফলন হল হোম টিউশন, অনলাইন টিউশন, এক্সট্রা ক্লাসেস ইত্যাদি।
বাচ্চারা কেন একাকিত্বে ভুগছে
শৈশবে অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে যৌবনে এসে সমস্যায় পড়লে সর্বপ্রথম চেষ্টা করতে হবে যত বেশি বন্ধু বানানো যায়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্পগুজব করা, পার্টি, যে-কোনও ইভেন্ট অ্যাটেন্ড করা, ট্রেনে-বাসে সকলের সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদিতে ধীরে ধীরে জড়তা কাটবে। ছাত্রাবস্থায় স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে অবশ্যই যোগদান করা বাঞ্ছনীয়। আশেপাশের সবকিছু জানার চেষ্ট করতে হবে। প্রথমে দ্বিধাবোধ হলেও ধীরে ধীরে যখনই নিজেকে প্রকাশ করতে শিখে যাবেন, দেখবেন অন্তর্মুখী হওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে।
হোম টিউশন
একটা সময় ছিল যখন মা-বাবার হাত ধরে বাচ্চার অক্ষরজ্ঞান হতো। এখন শৈশবেই একটি বাচ্চাকে হোম টিউশন এবং অনলাইন টিউশনে জোর করে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
৭-৮ ঘন্টা স্কুলে কাটিয়ে বাড়িতে এসেই আবার ১-২ ঘন্টা টিউশনে পড়ার বোঝা বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর উপর স্কুলের হোমওয়ার্ক, টিউশনের হোমওয়ার্ক তো আছেই। মা-বাবা আসলে চান বাচ্চাকে মেশিন করে তুলতে, যার অভিধানে ‘হাসিমুখে থাকা’ শব্দটাই নেই।
স্কুলের ৭টি ক্লাস বা পিরিয়ডস
সাধারণত স্কুলে ৬ থেকে ৭টি পিরিয়ডস হয়। একটা ক্লাস শেষ হলে বেল বাজে। নতুন ক্লাস শুরু হয়, নতুন টিচার আসেন। ক্রিকেটের ময়দানও এই একটাই ব্যপার! টিমের হার-জিত নির্ভর করে নতুন প্লেয়ারের টলারেন্স-এর উপর যে, সে কতটা চাপ নিতে সক্ষম।
ইকোনমিক টাইমস-এর একটি সমীক্ষা অনুসারে ভারতের ৯০ মিলিয়ন বাচ্চা প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা করে। প্রাইভেট স্কুলগুলিতে পড়াশোনা ছাড়াও এক্সট্রা অ্যাক্টিভিটিজ-এর নামে বাচ্চাদের কখনও প্রোজেক্ট, কখনও প্র্যাক্টিকাল, কখনও অ্যাসাইনমেন্ট অথবা ইভেন্টস করানোর অছিলায় ব্যস্ত রাখা হয়। স্কুলের লক্ষ্য একটাই থাকে, ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের বিশ্বাস করানো যে, স্কুল বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ তৈরির প্রচেষ্টায় আধুনিকতম পথ অবলম্বন করছে।
বাচ্চাদের জীবনে নির্ভরতার অভাব
শহরে আজ এমনই পরিস্থিতি যে বাচ্চাদের কাছে নির্ভর করার মতো মানুষের অভাব দিনে দিনে বাড়ছে। এমন কেউ নেই যার সঙ্গে বাচ্চা কিছুটা সময় কাটাতে পারে। স্কুলে পিরিয়ড শেষ হতেই শিক্ষক বদলাচ্ছে। টানা ক্লাস চলার ফলে ক্লাসে বন্ধুদের সঙ্গেও ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। স্কুল শেষ হতেই অভিভাবকেরা উপস্থিত হয়ে যান বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে অথবা বাস, কারপুল বাচ্চাদের নিয়ে রওনা দেয়।
বাস কিংবা কারপুলেও বাচ্চারা মন খুলে কথা বলতে পারে না কারণ বিভিন্ন ক্লাসের অন্য বাচ্চা সেখানে উপস্থিত থাকে। বাড়ি আসতেই টিউশন, হোমওয়ার্কের চাপ। এত ব্যস্ত জীবনশৈলীর কারণে বন্ধু বানানো যেমন সম্ভব হয় না তেমনই প্রতিবেশী বাচ্চার সঙ্গেও মেলামেশা করা সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চার মানসিক বিকাশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঠিক তেমনই বাচ্চা খোলামেলা স্বভাবের কিংবা সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে না।
সমাজের বাস্তবতা থেকে দূর
এনসিইআরটি-র রিপোর্ট অনুযায়ী এখানে বাচ্চারা প্রায় ৬ থেকে ৮ ঘন্টা স্কুলে সময় কাটায়। ওখানে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের একটা ব্রেক দেওয়া হয়। টানা ক্লাস চলার মধ্যে এই ৩০-৪০ মিনিটের ব্রেক বাচ্চাদের কাছে ফ্রেশ হাওয়ার মতন। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তারা বন্ধুদের সঙ্গে বসে গল্প করতে পারে নয়তো ওদের জীবনটা অনেকটা ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম-এর মতো যেখানে একটা ট্রেন ছেড়ে গেলেই অন্য ট্রেন এসে ঢুকে পড়ে।
শৈশব থেকেই দৌড় ঝাঁপ, পড়াশোনার চাপ, সময়ের অভাব অন্তঃসারশূন্য ব্যস্ততা, নতুন করে কারও সঙ্গে পরিচিতি না বাড়ার কারণে বাচ্চা বড়ো হয়ে সমাজের বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যায়। নিজের ভিতরেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে শৈশবের সারল্য হারিয়ে ফেলে তারা অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে।
অন্তর্মুখী হওয়ার প্রভাব যৌবনে
শৈশবে মা-বাবা বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা, উৎসব, পার্টি, খেলনা— -বাচ্চাদের জীবনে ব্যবহাহিক পরিবর্তন এনে খুশির সঞ্চার করে। কিন্তু নিজের কথা শেয়ার করতে না পারা, বন্ধু না থাকা, মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব, খেলাধুলার অভাব ইত্যাদি যৌবনে পৌঁছে বাচ্চার ব্যবহারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্বভাবগত ভাবে সে খিটখিটে হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে অবসাদ গ্রাস করার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সহজে প্রলোভনের শিকার
সামাজিক পরিস্থিতির কারণে টিনএজাররা সহজেই সোশাল মিডিয়া এবং সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিদের প্রলোভনের শিকার হয়ে পড়ে। কারণ সে সমাজের লেনদেনের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত-ই হয় না শৈশব থেকে। বহু মানুষ অনলাইনে কন্টেন্ট দেখেই আকর্ষিত হয়। সেটা ভালো হোক কি খারাপ কারণ তার কাছে পৃথিবীকে দেখার একটাই জানলা হল সোশাল মিডিয়া।
২০১৮-তে দেরাদুনের সহসপুর অঞ্চলে ৫জন নাবালক ছেলে একটি ৪ বছরের মেয়েকে গণধর্ষণ করে। তারা পরে স্বীকার করে, ওই জঘন্য অপরাধ করেছিল মোবাইলে পর্ণোগ্রাফি দেখেই।
সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের বদায়ু জেলার একটি ১১ বছরের ছেলের ৬ বছরের বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণের মামলা বেশ সাড়া ফেলে। অত ছোটো বাচ্চার মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা এল কোথা থেকে? এটাও কি সোশাল মিডিয়ার প্রভাব বলেই মনে হয় না?
এই ধরনের মানসিকতায় মানুষ একবার অভ্যস্ত হয়ে উঠলে সেটা ছাড়ানো মুশকিল হয়ে ওঠে। সাধারণত দেখা যায় অন্তর্মুখী বাচ্চা অপরের করা সাহায্যকে একটা কাজ বলেই মনে করে। সে ওই ব্যক্তি বা সাহায্যের জন্য বাধিত বোধ করেই না বরং প্র্যাক্টিকাল দিকটাই দেখে। এর ফলে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেগ এবং আদর্শ থেকে বাচ্চা ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে।
আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে
যৌবনে পৌঁছে বন্ধু বানাবার দ্বিধা, প্রাণ খুলে কথা বলার ভয়, নিজেকে অন্যের কাছে মেলে ধরার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি আরও অনেক ক্ষতির বোঝা যৌবনে সহন করতে হয়। যদি বাচ্চা শৈশবেই অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে, বুঝতে হবে সেটা ব্যস্ত জীবনশৈলী এবং একাকিত্বেরই ফল। এর জন্য প্রাপ্ত বয়সে বহু ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ বাচ্চা বড়ো হয়ে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে অযোগ্য বিবেচনা করতে থাকে।