প্রায় ভেজা সালোয়ার কামিজে নন্দিতা যখন শিয়ালদা স্টেশনে এসে পৌঁছোল তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজব বাজব করছে। সাউথ সেকশনের দিকে ছুটতে ছুটতে কানে এল ট্রেন লাইনে জল জমায় আর তার ছিঁড়ে যাওয়ায় অনেক ট্রেন বাতিল হয়েছে আজ। ডিজিটাল বোর্ডটায় দেখল আর একটি মাত্র ট্রেন ছাড়তে মাত্র তিন মিনিট মতো বাকি। দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটার কামরাগুলোর বেশিরভাগ কুপের জানলা এখনও ঝরতে থাকা বর্ষার জলের জন্য ভেতর থেকে বন্ধ। কোনও কোনওটার তো দরজাও অর্ধেক আটকানো। এমনই অবস্থা যে, কোনটা লেডিস, কোনটা গুডসের কামরা আর কোনটা জেনারেল — সেটাও ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না! ভাগ্যিস আজ চুড়িদার পরেছিল তাই রক্ষে, নাহলে শাড়ি পরে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ভিড় ঠেলে দৌড়ে ট্রেনটা ধরা সম্ভব হতো না নন্দিতার পক্ষে। মাত্রাতিরিক্ত ভিড় দেখেও এই দুর্যোগে ট্রেনটা যাতে মিস না হয় তাই তাড়াহুড়োয় একটা জেনারেল বগিতেই উঠে পড়ল নন্দিতা।

লোকাল ট্রেনে যাতায়াতের অলিখিত নিয়মই হল যে যার গন্তব্য স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম কামরার দুটো দিকের গেটের মধ্যে যেদিকে পড়বে সে সেই দিকের গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ট্রেন থেকে নামার সুবিধের জন্য। ফেরার সময় যাদবপুর স্টেশন পড়ে বাম দিকে কিন্তু ভিড়ের ঠেলায় নন্দিতা গিয়ে পৌঁছল কামরার দুই গেটের মাঝখান থেকে প্রায় ডান দিকের গেটের কাছাকাছি জায়গায়। বাম কাঁধে নেওয়া সাইড ব্যাগটা সামলে ডান হাত দিয়ে কোনও মতে ধরল ট্রেনের দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের জন্য টাঙানো হাতলগুলো।

আওয়াজ করে ছাড়ল ট্রেন। পার্ক সার্কাস ঢুকতেই যেন এতক্ষণের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা ট্রেনে উঠে ট্রেনের কামরাগুলোকে জনসমুদ্রে পরিণত করল। এমনই অবস্থা যে নন্দিতা যদি ধরার ঝোলা হাতলগুলো ছেড়েও দেয় তবুও শুধু ভিড়ের চাপে এমনিই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। লোকে যে দুই কামরার মাঝে আর মাথায় চেপে বসেনি এই অনেক!

পার্ক সার্কাস থেকে ট্রেনটা ছাড়তেই হঠাৎ শরীরে এক অজানা অস্বস্তি টের পেতে শুরু করল নন্দিতা। পেছন থেকে একটা অচেনা হাত প্রথমে ঠেকল ওর দেহে তারপর ক্রমশ সেটা নন্দিতার বুকের কাছ থেকে শুরু করে উরুর উপর পর্যন্ত অশ্লীল ভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করে চলল ওর শারীরিক গোপনীয়তাকে! এর আগে কোনওদিন এইরকম অবস্থার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে না পারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় নন্দিতা, আগুপিছু কোনও দিকে ঘুরে তাকাতে এবং নড়াচড়া করতে না পেরেও খপ করে ডান হাত দিয়ে চেপে ধরল মানুষরূপী পশুটার হাতটা। উদ্দেশ্য, এই যে ভিড়টা একটু কমলেই জঘন্য কীটটার হাতটা টেনে সামনে এনে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় কষানোর। ওর একবার মনে হল আশেপাশের কেউ কি কিছু দেখতে পাচ্ছে না এই সাংঘাতিক ভিড়ে নাকি ও চেঁচিয়ে কারও থেকে কোনও সাহায্য চাইছে না বলেই কেউ আগ বাড়িয়ে অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে চাইছে না! কোনও মহিলা যাত্রীও তো চোখে পড়ছে না এই মানুষের মাথার ভিড়ে! এখন যদি পরের স্টেশন আসার আগেই লাইন ক্লিয়ার বা সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেনটা হঠাৎ থেমে যায় তবে ঠিক কী করা উচিত হবে তার? স্থির করতে না করতেই ট্রেনটা ঢুকেছে বালিগঞ্জ স্টেশনে। আরেকপ্রস্থ জনজোয়ারের সুযোগে নোংরা লোকটা নন্দিতার হাত ছাড়িয়ে কেটে পড়েছে, সম্ভবত ট্রেন থেকে নেমে গেছে স্টেশনে। চেহারা না দেখতে পাওয়ায় যাকে চেনা আর সম্ভব নয় নন্দিতার পক্ষে, শাস্তি দেওয়া তো অনেক দূরের কথা! শরীর আর মস্তিষ্কের ঘেন্না আর রাগটাকে বাধ্য হয়ে মনেই চেপেই রাখতে হল তাই!

আর এক স্টেশন পরেই যাদবপুর। ভিড় অনেকটা কমে কামরায় চলাফেরা করার মতো স্বাভাবিক অবস্থাতে এলেও যেন হঠাৎই জড়বস্থানু হয়ে গেছে নন্দিতা। এতটাই যে বাম দিকের গেটের কাছে যেতেও যেন পা সরছে না ওর! আরেকটু অল্প বয়স হলে হয়তো চোখে জল বাঁধ মানত না কিন্তু মাঝ-বয়সের অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে বাড়ির বাইরে রাস্তাঘাটে নিজের আবেগকে সংযত ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, নাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবুও অপমানে লাল হয়ে থাকা নাকের পাটা আর অসম্মানে গরম হয়ে ওঠা কান নিয়ে নন্দিতার ইচ্ছে করছে কোনও অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে অথবা গলা ফাটিয়ে খুব খুব জোরে চিৎকার করতে— যেটার কোনওটাই করা সম্ভব নয় তার পক্ষে, অন্তত এই মুহূর্তে!

নন্দিতার মুখ-চোখের অবস্থা লক্ষ্য করেই বোধহয় ট্রেনের গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা পিতৃস্থানীয় এক বয়স্ক ভদ্রলোক হয়তো বা কিছু একটা আঁচ করেই বলে উঠলেন— ‘ট্রেনে ভিড় থাকলে জেনারেলে না উঠে লেডিসে উঠবেন, মা… ‘

যাদবপুরে নেমে স্টেশনের ওভারব্রিজের সিঁড়িটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ওড়নাটা ঠিক করতে করতে সবে একটু ধাতস্থ হয়েছে নন্দিতা; চোখের সামনে দিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে লোকাল ট্রেনটা একটু আগেই যেটার যাত্রী ছিল সে। হঠাৎ খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলন্ত ট্রেনটার একটা বগির গায়ে ‘মহিলা কামরা’/ ‘মহিলাও কে লিয়ে আরক্ষিত’/ ‘লেডিস ওনলি’— লেখাগুলো চোখে পড়ল নন্দিতার আর জীবনে এই প্রথমবার ‘লেডিস কম্পার্টমেন্ট’ বাক্যাংশটাকে একটা নীরব সুরক্ষাবলয়ের মতো মনে হল তার।

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...