প্রতিদিন স্নানের সময় ত্বকের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে আমরা সকলেই বেশ যত্নশীল থাকি। বডি স্ক্রাব, বডি ওয়াশ, বডি অয়েল প্রভৃতি প্রসাধনীর পিছনে ব্যয়ও করি, যাতে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা যায়। বর্ষায় এই সতর্কতা তো আরও বেশি। কারণ বৃষ্টির জলে ভিজে বা নোংরা কর্দমাক্ত পথে বেরোলে ত্বকে নানারকম সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। তাই পার্সোনাল হাইজিন, টয়লেট হ্যাবিটস, বাথরুমের পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতিতে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি থাকে। কিন্তু একইরকম সতর্কতা কি আমরা আমাদের তোয়ালের প্রতি দেখাই? আপনি শেষ কবে আপনার স্নানের তোয়ালেটি কেচেছেন? ১ সপ্তাহ আগে নাকি ১৫ দিন আগে?

হ্যাঁ অবাক হবেন না, তোয়ালে কাচার বিষয়ে অনেকেরই একটা স্বভাবসিদ্ধ আলস্য কাজ করে। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, দামি বডিওয়াশ ব্যবহার করে, ত্বক তো পরিচ্ছন্ন করলেন কিন্তু স্নানের পরই যখন শরীর মোছার প্রয়োজন হয়— তখন আপনি না কাচা অস্বাস্থ্যকর তোয়ালেটাই প্রতিবার ব্যবহার করেন।

এই বদভ্যাস থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসুন। আপনার জানা দরকার যেভাবে আপনি অতি সতর্কতার সঙ্গে শরীরে ময়লা জমতে দেন না, একই ভাবে তোয়ালেরও ময়লা পরিষ্কার করা উচিত। বর্ষাকালে ত্বকের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। তাই তোয়ালে পরিচ্ছন্ন না হলে নানা ধরনের চর্মরোগের কবলে আপনি পড়তে পারেন। আসুন জেনে নেওয়া যাক এর থেকে বাঁচতে কীভাবে তোয়ালে পরিচ্ছন্নতায় সজাগ হবেন।

ভেজা তোয়ালে ক্ষতির মুখে

সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল মোটা তোয়ালে বর্ষাকালে শুকোতে চায় না, আর ভেজা তোয়ালে ব্যবহারের ফলে ত্বকে নানা সংক্রমণ হতে পারে। প্রতিদিন তোয়ালে সাবান দিয়ে কাচা সম্ভব হয় না। তাই চেষ্টা করুন যখনই রোদ উঠবে, তখনই তোয়ালেটা কড়া রোদে ফেলে রেখে সম্পূর্ণ শুকনো ও জার্ম ফ্রি করে নিতে। ভেজা স্যাঁতসেতে তোয়ালে ব্যাক্টিরিয়ার আঁতুড়ঘর। যেটা সরাসরি আপনার ত্বকের সংস্পর্শে এলে ক্ষতি হবে। তাই চেষ্টা করুন বর্ষাকালে একদিন ছাড়া অ্যান্টিসেপটিক লিকুইড মেশানো জলে, তোয়ালে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে।

টাওয়েল ক্লিনিং

সে যে-তোয়ালেই হোক— আপনার স্নানের টাওয়েল, ফেস টাওয়েল বা হ্যান্ড টাওয়েল, পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টিকে অবহেলা করলে চলবে না। টাওয়েল ত্বকের সরাসরি সংস্পর্শে আসে। ফলে আপনার ত্বকের ডেডস্কিন বা ঘাম সরাতে এটিকে ব্যবহার করা হয়। সপ্তাহে ২-৩ বার টাওয়েল ডিটারজেন্ট ও গরমজলের মিশ্রণে ডুবিয়ে রাখুন, তারপর রগড়ে কেচে নিন।

পরিষ্কারের পদ্ধতি

পরিষ্কারের আরও একটি পদ্ধতি হল, স্বাভাবিক তাপমত্রার জলে ডিজারজেন্ট ছাড়াও একটু ভিনিগার দিন। এর ফলে তোয়ালেতে জমে থাকা সমস্ত ব্যাক্টিরিয়া সহজে বেরিয়ে আসবে। এটা শুধু জার্ম ফ্রি করতেই সহায়তা করে না, ভেজা তোয়ালের বিশ্রি গন্ধ থেকেও মুক্তি দেয়।

আপনি তোয়ালেটি জার্ম ফ্রি করতে বেকিং সোডাও ব্যবহার করতে পারেন। ডিটারজেন্ট-এ তোয়ালে কাচার পর জলে বেকিং পাউডার গুলে, তোয়ালে ডুবিয়ে নিন। তারপর ভালো ভাবে চেপে জল ঝরিয়ে নিয়ে কড়া রোদে তোয়ালে শুকোতে দিন।

জিম টাওয়েল ধুয়ে নিন প্রতিদিন

জিম টাওয়েলের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন। আমরা নিজেদের ফিটনেসের বিষয়ে যতটা সচেতন, ততটাই উদাসীন জিম টাওয়েলের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে। ভেবে দেখুন জিমে আপনি কতটা ঘাম ঝরানোর ব্যায়াম করেন, তারপর সেই ঘাম মুছতে সাহায্য নেন জিম টাওয়েলের। আফটার জিম স্নান সেরে আপনি ঘর্মাক্ত টাওয়েলেই আবার গা মুছে নেন। এটা কি সত্যিই হাইজিনিক? আপনি নিজে স্নান শেষে ফ্রেশ ফিল করতে পারেন ঠিকই কিন্তু আপনার তোয়ালে তো বহন করছে ঘাম থেকে জন্ম নেওয়া ব্যাক্টিরিয়া।

তাই জিম টাওয়েল যদি প্রতিদিন ব্যবহারের পর না কেচে রাখেন ত্বকের সংক্রমণ এড়ানো কঠিন হবে। টাওয়েল হাইজিন তাই হেলাফেলার বিষয় নয়। প্রত্যেকবার ইউজ-এর পর টাওয়েল ধোয়া মাস্ট। এই পদ্ধতি যদি আপনি নিয়মিত অবলম্বন করেন, তাহলে তোয়ালেতে তৈরি হওয়া জার্ম থেকে অ্যালার্জি হবে না। ভাইরাস প্রভৃতি তোয়ালে থেকে আপনার শরীরে প্রবেশ করবে না। যে-কোনও বড়ো সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমবে।

জিম টাওয়েল ধোওয়ার পদ্ধতি

এই টাওয়েল পরিষ্কার করতে হলে ভালো ভাবে ডিটারজেন্ট জলে গুলে নিন। এতে কয়েক ফোঁটা ভিনিগার বা বেকিং সোডা এক চিমটে দিয়ে দিন। কিছুক্ষণ এই মিশ্রণে তোয়ালে ডুবিয়ে রেখে, তারপর কাচুন। এবার একটি বালতিতে কয়েক ফোঁটা ডিসইনফেকট্যান্ট লিকুইড দিয়ে দিন। তোয়ালে এই জলে ভালো ভাবে ধুয়ে নিয়ে তারপর শুকোতে দিন। বেকিং সোডা বা ভিনিগারের অন্য গুণও আছে। এটা তোয়ালেকে জার্ম ফ্রি তো করবেই, সেইসঙ্গে তোয়ালের সফটনেস বজায় রাখতেও সাহায্য করবে। স্যাঁতসেঁতে গন্ধও দূর হবে।

কিচেন টাওয়েলও রাখুন সুরক্ষিত

আমরা রান্নার পর বা খাবার খাওয়ার পর বাসন যেমন পরিষ্কার করি, ততটা কি মনোযোগ দিই কিচেন টাওয়েলের ব্যাপারে? বেশির ভাগ মহিলাই উত্তরে ‘না’ বলবেন। সত্যিই আমরা কিচেন টাওয়েলটিকে অবহেলা করে থাকি। মাল্টিপারপাস কিচেন টাওয়েল, হাত মোছা, ভিজে বাসন মোছা— সব কাজেই লাগে। ফলে এতে ব্যাক্টিরিয়া জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে ষোলোআনা। বিশেষ করে এই টাওয়েল যারা একইসঙ্গে কিচেন স্ল্যাব মোছা, গ্যাস আভেন বা মাইক্রো আভেন মোছার কাজেও ব্যবহার করেন— তাদের তো পরিচ্ছন্নতার দিকে আরও নজর দেওয়া উচিত।

প্রতিদিন এই তোয়ালে না ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করবেন না। এই অস্বাস্থ্যকর তোয়ালে কিন্তু আপনার শরীরে জীবাণু বহন করে আনবে। বর্ষাকালে বিশেষ করে এই তোয়ালে দিয়ে বাসন মুছে যদি সেই বাসনে খাবার খান, পেটের অসুখ ঠেকানো মুশকিল হবে। এই তোয়ালে বস্তুত ব্যাক্টিরিয়া লালন করে সবচেয়ে বেশি, তাই স্বাস্থ্যের ক্ষতি যাতে না হয়, এখনই সচেতন হোন।

কী বলছে গবেষণা

লভ ২ লন্ড্রি নামক সংস্থার রিসার্চ বলছে, খুব অল্প সংখ্যক মানুষ প্রতিবার ব্যবহারের পর নিজের তোয়ালে ধুয়ে রাখেন। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ মনেই করতে পারেন না তেয়ালে শেষ কবে ধুয়েছেন। একটা সার্ভেতে দেখা গেছে মাত্র ৪৬ শতাংশ মানুষ, সপ্তাহে একবার করে ব্যক্তিগত টাওয়েল ধুয়ে পরিষ্কার করেন। ৯ শতাংশ মাসের অধিক সময়কাল ধরে তোয়ালে ধোওয়ার কথা ভাবেনই না। তোয়ালে থেকে চর্মরোগ হওয়ার সম্ভাবনা তাই সবচেয়ে বেশি। নিজেকে স্নানের দ্বারা পরিষ্কার করলেও এরা টাওয়েল হাইজিনের বিষেয়ে মোটেই সচেতন নন।

স্নানের পর তোয়ালের সাহায্যে অনেকেই গা ঘষতে থাকেন। এতে ডেডস্কিন তোয়ালেতে ট্রন্সফার হয়ে যায়। আর্দ্রতার সংস্পর্শে এসে এটাই ব্যাক্টিরিয়ার জন্ম দেয়। না ধুয়ে যখন এই তোয়ালে ব্যবহার করা হয়, এই ব্যাক্টিরিয়া সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে আসে। ইনফেকশন, অ্যালার্জি, ত্বকে প্রদাহ, ফুসকুড়ি, প্যাচি স্কিন, র‍্যাশ প্রভৃতি সমস্যার শিকার হতে হয়। তাই টাওয়েল হাইজিন-কে আপনার জীবনের অঙ্গ করে ফেলুন।

পরিষ্কার করবেন কীভাবে?

এই তোয়ালে প্রতিদিন কাচুন। তাহলে এর দুর্গন্ধ দূর হবে। বাসনে এই অস্বাস্থ্যকর তোয়ালের গন্ধ লেগে থাকবে না। গরম জলে ভিনিগার ফেলে, কিচেন টাওয়েলটি অন্ততপক্ষে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন। এতে ব্যাক্টিরিয়া এবং দুর্গন্ধ— দুই-ই নির্মূল হবে। আজকাল কাপড়-জামা ধোওয়ার জন্য যে-সুগন্ধী পাওয়া যায়, দু-চার ফোঁটা সেই তরল জলে গুলে কিচেন টাওয়েল ধুয়ে নিন। পরিচ্ছন্ন ফিল আসবে।

নির্দিষ্ট সময়ের পরে টাওয়েল বদলান

একই তোয়ালে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে যাবেন না। তোয়ালের রোঁয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। তখন তা পরিচ্ছন্নতার বা ত্বক শুকনো করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই ধরনের তোয়ালেতে নোংরা জমেও থাকে বেশি। তাই দু- তিনমাস অন্তর হ্যান্ড টাওয়েল বা জিম টাওয়েল বদলান।

তোয়ালে বদলাবার সময় হয়েছে কীভাবে বুঝবেন? এটা কাচার পরও যদি দেখেন তোয়ালে থেকে দুর্গন্ধের ভাবটা পুরোপুরি যায়নি, তখন বুঝতে হবে এর ফাইবারে ব্যাক্টিরিয়া রয়ে গেছে। এই তোয়ালে আপনার ত্বকের জল শুষে নেওয়ার ক্ষমতাও হারাতে থাকবে। তাই এটাই সঠিক সময় তোয়ালে বদলানোর।

তোয়ালে শেয়ার করবেন না

অনেকের অভ্যাস থাকে অন্যের তোয়ালে ব্যবহার করার। এই অভ্যাস দ্রুত পালটান। আপনার তোয়ালে কাউকে দেবেন না। নিজের ব্যক্তিগত তোয়ালে ব্যবহার করাই স্বাস্থ্যকর। এর কারণ আপনি যাকে তোয়ালে ব্যবহার করতে দিচ্ছেন, হতে পারে তিনি কোনও ব্যাক্টিরিয়া বহন করছেন, যা তোয়ালের মাধ্যমে সহজেই সংক্রামিত করবে আপনার ত্বককেও। তাই চর্মরোগের সম্ভাবনা থেকে বাঁচতে নিজের তোয়ালে ও ডিসইনফেকট্যান্ট অবশ্যই সঙ্গে রাখুন। পুলে যদি তোয়ালে নিয়ে যান, তাহলে অন্যের ভেজা টাওয়েল ব্যবহার করার থেকে বিরত থাকুন। ভেজা তোয়ালেতে ফাংগাল ইনফেকশনের সম্ভাবনা খুব বেশি। বর্ষায় ইউরিন ইনফেকশনের মতো সমস্যাতেও পড়তে পারেন, যদি না পার্সোনাল হাইজিন বজায় রাখেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...