তখন আমি ব্যাচেলর, পাটনাতে এক বাঙালি ভদ্রলোকের বাড়িতে ভাড়া থাকি। বাড়িওয়ালা ও বাড়িওয়ালি অতি সজ্জন ও ভালোমানুষ। মাসিমা অর্থাৎ বাড়িওয়ালি ছিলেন প্রকৃত মাতৃসুলভ মহিলা। ওনাদের সন্তান বলতে ছিল একটিমাত্র মেয়ে। ননদের বড়ো ছেলে ওনাদের কাছেই থাকত। পুত্রস্নেহে মামিমা ভাগ্নের খুব যত্ন করতেন। ভাগ্নেও মাইমা বলতে অজ্ঞান ছিল। পৃথিবীতে কিছু সুন্দরদর্শন মানুষ থাকেন যাদের সুন্দর ব্যবহার তাদের রূপকেও ছাপিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ ওনাদের গুণে মোহিত হয়ে যায়, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, মান্য করে এবং প্রায় ভগবানের জায়গায় বসায়। মাসিমা ছিলেন সেই রকমই এক অতি সমাদৃতা মহিলা।
মাসিমার ভাগ্নে আমার থেকে বয়সে অনেকটা বড়ো ছিলেন। সমীরদা বলে ডাকতাম। সমীরদা মানুষটা একটু মুডিয়াল ছিলেন। কখনও হেসে কথা বলতে আসতেন, আবার কখনও গাম্ভীর্য দেখিয়ে এড়িয়ে যেতেন। বাড়িওয়ালির আদরের ভাগ্নে, আমিও তাই ওনার মন বুঝে চলতাম। রাস্তা চলতেন একটু টালমাটাল ভঙ্গিতে। এক সরকারি কলেজে ক্লার্কের চাকরি করতেন। চাকরিতে হাজিরা, মাইমার একটু-আধটু ফরমায়েস তামিল করা, আর এদিকে-ওদিকে ফাঁকা সময়ে আড্ডা দেওয়া— এটাই ছিল সারাদিনের রুটিন।
জীবনের রাস্তাও চলতেন টালমাটাল ভঙ্গিতে। সেরকম কোনও মোহ নেই, নেই কোনও তাড়াহুড়ো, বিয়ে করা অথবা সংসার করার ব্যাপারে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। সমীরদার আচরণে সমীরদার বাবা-মা এবং মামা-মামি ভুল করেও এই ধরনের কোনও কথা মুখেও আনত না। গয়ং গচ্ছ ভাবে চলতে চলতে একদিন সবাই লক্ষ্য করল সমীরদার থেকে স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে গেছে। উন্মাদনা না থাকলেও মানসিক সুস্থতা নেই। ডাক্তার-বদ্যি করেও হাল ফেরানো গেল না। একটা ভয় ও অনিশ্চয়তা ওনাকে তাড়া করে বেড়াত।
কলেজ যাওয়া বন্ধ হল। সারাদিন বাড়িতে পায়চারি করতেন। সন্ধে হলে বেরিয়ে যেতেন, বাড়ি ফিরতেন রাত দশটা নাগাদ। গেট খোলার সময় বাইরের গ্রিলের গেটে ছোট্ট লোহার কড়া ওঠানোর আওয়াজ এবং গেট বন্ধ করার সময় কড়া ফেলার আওয়াজ শোনা যেত। আমি ও আমার রুমমেট আশিস বলতাম, “ওই যে সমীরদা বাড়িতে ঢুকল।’
সমীরদার পাগলামো বেড়ে যাওয়াতে মাসিমা তার ননদ ও নন্দাইকে ডেকে পাঠিয়ে, ওনাদের বাড়িতে সমীরদাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বললেন। সমীরদা ‘মাইমাকে’ ছেড়ে যেতে নারাজ। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর মা-বাবা বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। কিছুদিন পরেই খবর এল সমীরদা আত্মহত্যা করেছেন। সাঁতার জানতেন না, গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। দু-দিন পরে গঙ্গায় এক কিনারে দেহ ভেসে ওঠে।
এর কিছুদিন পর থেকেই বাড়িতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। বাড়িতে ঢোকার ছোট্ট গ্রিলের গেটে কখনও তালা লাগানো হতো না কারণ অনেক ভাড়াটে থাকত, কে কখন ঢুকবে বা বেরোবে তার ঠিক নেই। এমনিতে তালা দিয়েও লাভ নেই কারণ নীচু পাঁচিল, ইচ্ছা করলে যে-কেউ পাঁচিল টপকে ঢুকতে পারে। সমীরদার মৃত্যুর পর মাসিমারা তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তেন। আর তারপরই….
তারপরই, রাত দশটা বাজলে যে-কোনও সময়, বাড়িতে ঢোকার ছোট্ট গ্রিলের গেট খোলার আওয়াজ আসত। সাধারণ ভাবে গেটের আওয়াজ নিয়ে মাথাব্যথা হওয়ার যুক্তি নেই, অবকাশও ছিল না কারওর। সময়টা ছিল জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় পাটনাতে সবাই তখন সন্ধ্যা আটটার মধ্যেই ঘরে ঢুকে পড়ত। শীত বাড়লে আওয়াজের তীব্রতা বাড়ে। পাশের বাড়িতে কাচ ভাঙলে, মনে হয় নিজের বাড়িতে অঘটন ঘটল। নিঝুম রাতের নির্জনতা ভেঙে কড়ার আওয়াজ সবার কানে বাজতে লাগল। একদিনের ব্যতিক্রম নয়, রোজদিনের এই অস্বাভাবিক আচরণ সবার মনে প্রশ্ন জাগাত।
নতুন করে এত রাতে রোজ কে আসছে? ঔৎসুক্যবশত একদিন রাতে গেট খোলার ও বন্ধ করার আওয়াজ হতেই ঝুল বারান্দা দিয়ে গেটের দিকে নজর দিলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। ব্যাপারটা যেহেতু বাড়ির সুরক্ষার সাথে জড়িত, তাই বাড়িওয়ালাকে রিপোর্ট করলাম। সব শুনে বাড়িওয়ালা বললেন, ‘এরকম কোনও আওয়াজ তো শুনতে পাই না আমরা।’ রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘রাত দশটা নাগাদ গ্রিলের গেট খোলার আওয়াজ শুনতে পান না আপনারা?” একদম নির্লিপ্ত অথচ নিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘না তো!”
বাড়ির অন্য ভাড়াটেরা অবশ্য আমার কথা মানল। আওয়াজ ওদের কানেও পৌঁছোয়। ওদের ধারণা ছিল কাণ্ডটা আমরাই করি। যেহেতু আমরা ব্যাচেলর, সুতরাং এরকম ঘটনা ঘটানো আমাদের দ্বারা স্বাভাবিক ভাবে অসম্ভব নয়। বাড়িওয়ালার সাথে এই ব্যাপারে আর কথা না বাড়ালেও, কেউ যে দশটার সময় গেট খুলে এই বাড়িতে ঢোকে, সেটা মনের থেকে ঝেড়ে ফেলা গেল না। মনে মনে ভাবলাম — হয়তো ঘটনা যখন ঘটে তখন ওনারা গভীর ভাবে নিদ্রামগ্ন থাকেন। ওনাদের কথায় নিজের মনকে শান্ত করার জন্য যুক্তিবাদী ভাবনার আশ্রয় নিলাম। ভাবলাম ওই সময় বাইরে থেকে এই বাড়িতে বিড়ালের আগমন ঘটে।
গ্রিলের ফাঁক গলে যখন তিনি ঢোকেন তখন দুদিকের পাল্লা দুটো একটু নড়ে যায় আর তার ফলে লোহার কড়া একটু উঠে আবার যথাস্থানে পড়ে যায়। আর তখনই ঘটে এই ভুতুড়ে আওয়াজ। আর এই ভাবনাকে বাস্তব প্রমাণ করতে একদিন আওয়াজ হতেই বাইরে ঝুলবারান্দা থেকে গেটের দিকে তাকাই। টর্চের আলো গেট ও তার আশেপাশে ফেলে দেখি গেটের কাছে না কোনও বিড়াল না কোনও কুকুর দেখা যাচ্ছে। আর গেটটাও ঠিকঠাক বন্ধ করা আছে।
(ক্রমশ…)