আচমকা নূপুরের শব্দে সম্বিৎ ফেরে রেহানের। এই নির্জন ঢিবিতে নূপুরের আওয়াজে হকচকিয়ে যায়। চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে সোজা উঠে যায় ঢিবির উপরে। ঠিক তখনই ও দেখতে পায় একটি মেয়ে ধীরে ধীরে ঢিবির গা’বেয়ে উপরে উঠে আসছে। গায়ে হলুদ রঙের সালোয়ার। পায়ের তোড়ায় লাগানো নূপুরগুলো থেকে শব্দটা ভেসে আসছে বাতাসে ভর করে। রেহানের সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটি থমকে দাঁড়ায়। তারপর মাথা নীচু করে উঠে আসে ঢিবির উপরে।

দোহারা লম্বা, শ্যমলা মেয়েটির চোখ দুটো আকাশজোড়া। একমাথা ঘন কালো কোঁকড়া চুল কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে। রেহান মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসে। গালের পাশ থেকে চুল সরিয়ে সামান্য মাথা তুলে হাসল মেয়েটি। নদীর ঘূর্ণির মতো দুটো টোল পড়ল গালে। মেয়েটির হাসিটা খুব ভালো লাগল রেহানের।

—তোমার এখানেই বাড়ি? জিজ্ঞেস করল রেহান।

—হ্যাঁ, বলে ঢিবির উপর থেকে হাত দিয়ে ইশারায় ওদের গ্রামটার দিকে নির্দেশ করল মেয়েটি। রেহান তাকিয়ে দেখল দূরে গাছপালার আড়ালে একটি গ্রাম। কয়েকটি খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর দেখা যাচ্ছে।

রেহান জানতে পারল মেয়েটির নাম প্রমা। এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ইতিহাসে অনার্স। রেহান খুব খুশি হয়ে প্রমাকে জিজ্ঞেস করল তালিত গড়ের ঢিবি সম্বন্ধে।

প্রমা বলল, “তালিত গড়ের ঢিবি আসলে একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী। এখানে যে মোট ১৬টা ঢিবি আছে তার প্রত্যেকটিতে ছিল একটি করে কামান। কামানগুলিতে ফারসি ভাষায় খোদিত ছিল বর্ধমানের মহারাজা চিত্রসেনের নাম। বর্গিনেতা ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ২০ হাজার মারাঠা সৈন্য নাগপুর থেকে অগ্রসর হয়ে বর্ধমানে প্রবেশ করে। মহারাজা চিত্রসেন আগেই বর্গিদের আগমনের বার্তা পেয়েছিলেন, তাই তিনি রাজধানীর নিকট তালিতে এই গড় কেটে রেখেছিলেন। মারাঠা সৈন্যদের আটকানোর জন্য।’

এই প্রথম ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে কারও কাছ থেকে সঠিক তথ্য পেল রেহান। বই পড়ে যেটুকু জেনেছিল সেটা প্রায় সবটাই মিলে গেল প্রমার কথার সঙ্গে। এরপর কখনও ওই ঢিবিতে গেলে প্রমার সঙ্গে দেখা করত রেহান। ধীরে ধীরে মিশে গেছিল ওদের পরিবারের সঙ্গে। এই ভাবে অজান্তেই কখন প্রমার প্রেমে পড়ে গেল। দুটি পরিবারের মধ্যে বিশাল সামাজিক ব্যবধান আছে জেনেও প্রমাকে ভালোবেসেছিল রেহান।

বর্ধমান শহরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে রেহান। মফস্সলে ভালোই প্রতিপত্তি ছিল মুখোপাধ্যায় পরিবারের। ওদের সম্পর্কটা যে অত্যন্ত রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন ওদের পরিবার মেনে নেবে না, তা ভালোই জানত রেহান। প্রমার মা মারা যাবার পর যখন প্রমার বাবা রেহানকে বিয়ের কথা বলে, তখন বাবার দিকে মুখ তুলে কখনও কথা না বলা রেহান আচমকা সাহসী হয়ে বাবাকে সবটা জানায়। রেহানের অনুমানমতো একজন অন্ত্যজ পরিবারের মেয়ের সাথে ওর বিয়েটা মেনে নিতে অস্বীকার করে পরিবারের সবাই। ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সংসার করতে বদ্ধপরিকর রেহান একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নিয়ে, প্রমাকে বিয়ে করে মফস্সল ছেড়ে চলে যায়।

মাস ছয়েক পরে আচমকা একদিন রেহানের বাবা ওদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। ওদের বিয়েটা মেনে নিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন ওদের। রেহান চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাবার ব্যাবসায় মন দেয়। সপ্তাহ খানেক পরে একদিন অফিস থেকে ফিরে রেহান জানতে পারে প্রমা চলে গেছে। রেহানের বাবা ওর হাতে একটা চিঠি দেয়। যেখানে প্রমা নিজের হাতে লিখেছে— ‘ও রেহানকে কোনওদিন ভালোবাসেনি। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েও রেহানের সঙ্গে মেলামেশা করেছিল সেটা পূর্ণ হওয়ায়, সে আর রেহানের সঙ্গে থাকতে চায় না। ও যেন আর কোনও দিন ওর খোঁজ না করে। ‘

ওর কাকা আরও বলেন যে, তিনি নাকি দেখেছেন বাইরে একটা ছেলে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই গাড়িতে চেপে প্রমা চলে গেছে। মনোরঞ্জনবাবু একটা চেকবুক বার করে দেখায় রেহানকে যেখানে দু’লক্ষ টাকার একটা অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক কাটা হয়েছে প্রমার নামে। মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল রেহানের। প্রমার বিশ্বাসঘাতকতায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে সে। প্রমার স্মৃতি মনের মধ্যে ভিড় করে আসত এই শহরে। কিছুদিন পর একটু স্বাভাবিক হয়ে সাংবাদিকতার চাকরি নিয়ে দিল্লি চলে যায় রেহান।

স্মৃতির জাল কাটিয়ে, ঢিবি থেকে নেমে গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় রেহান। কাদামাটির রাস্তাটা ঢালাই হয়েছে। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে গ্রামটার। উন্নয়নের জাঁতাকলে কাটা পড়েছে গ্রামের ঢোকার রাস্তার পাশের সেই মেহগনি গাছটা। একটা বড়ো স্টেশনারি দোকান হয়েছে সেখানে। একটু এগিয়ে দোকানের সামনেটায় গিয়ে দাঁড়াল রেহান। আচমকা একটি মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখে চমকে যায়! এ কাকে দেখছে ও! যেন কুড়ি বছর আগেকার প্রমা। কিন্তু গায়ের রং শ্যামলা নয়। নিজের দিকে তাকাল রেহান। মেয়েটার গায়ের রং অনেকটা ওরই মতো। পায়ে পায়ে ওকে অনুসরণ করে গিয়ে ওদের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়ায় রেহান। বাড়িটা ওর চেনা। শুধু আগের তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরটা এখন পাকা হয়েছে। দরজাটা খোলাই ছিল। ভেতরে ঢুকে পড়ল রেহান। মাথা নীচু করে একজন মেশিনে সেলাই করে চলেছে। পায়ের শব্দে মহিলাটি মুখ তুলতেই রেহান মুখোমুখি হল প্রমার। কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক দুজনেই।

প্রমার আকাশজোড়া চোখ দুটোয় আজও নিজের ছবি দেখতে পাচ্ছে রেহান। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আড়ালে হালকা বলিরেখা। কালো কোঁকড়া চুলগুলো গাল দুটো ঢেকে রেখেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে অস্ফুট গলায় রেহান বলে ওঠে, ‘প্রমা!”

প্রমা কোনও উত্তর দেয় না। শুধুই তাকিয়ে থাকে। অনেকদিনের জমা অভিমান চোখের জল হয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে দু’গাল বেয়ে। ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রমার পাশে দাঁড়াল মেয়েটি। সেই মুখ, সেই চেহারা অবাক হয়ে দেখতে থাকে রেহান।

অপেক্ষার বাঁধ ভাঙে। প্রমা বলে উঠল, “তুমি এসেছ রেহান’! রেহান তখন সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। প্রমা বুঝতে পারে। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘অবাক হচ্ছ ওকে দেখে! ও রেশমি। আমাদের মেয়ে। মাস ছয়েক তো সংসার করেছিলাম!’

—কেন চলে এসেছিলে প্রমা?

—আমি বাধ্য হয়েছিলাম। তোমার বাবা আমাকে দিয়ে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, না লিখলে আমার বাবাকে…। তোমার বিধায়ক কাকা আর অর্থবান বাবার কাছে আমরা…!

বইয়ের ফাঁক থেকে একটা কাগজ বের করে রেহানের হাতে দিল প্রমা। বাবার সই করা সেই চেকটা দেখে কেঁদে ফেলল রেহান। প্রমার হাতের উপর হাত রেখে বলল, ‘ক্ষমা করে দিও।’

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...