আশিসকে জিজ্ঞেস করাতে বলল, গেট খোলার আওয়াজ ও পরিষ্কার শুনেছে। ও আরও বলল, ‘আমি একদিন ঝুল বারান্দাতেই বসেছিলাম, আওয়াজ হতেই তাকিয়ে দেখি গেট কিন্তু বন্ধ। চার ব্যাটারির টর্চ এনে গেটের সামনে আলো ফেলে দেখি কেউ নেই।’

কিছুদিন পর খেয়েদেয়ে কিছু পেপার ওয়ার্কস নিয়ে বসেছি। আশিস শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল, দশটা বেজেছে, যথারীতি গেট খোলার আওয়াজ এল। আশিস জিজ্ঞেস করল, ‘গেটের কড়া লাগানোর আওয়াজ পেলি কি?’ বললাম, ‘কানে এল।’ মজা করে আশিস আমাকে বলল, “গুরু এ বাড়িতে রোজ রাতে ভূত আসে। চল অন্য বাড়িতে যাই। সমীরদা মাঝে মাঝেই রাত্রিবেলায় এখানে এসে ফিল্টার উইলস খেতেন। কোনওদিন সেটা মনে পড়ে আমাকে দর্শন দিলে আমি হার্টফেল করব। চলো গুরু এখান থেকে পালাই।’ বললাম, ‘এখন এই বাড়ি আর ছাড়া নেই। আজকাল ছিঁচকে চোরের উৎপাত বেড়েছে। সমীরদা মামাবাড়ি পাহারা দিতে রোজ রাতে চলে আসেন। আমাদের আর কিছু চিন্তা করার দরকার নেই। সমীরদাই দেবেন চোরের ঘাড় মটকে।

রাত দশটার গেটের আওয়াজের চর্চা এখন বাড়ির সব ভাড়াটেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সাথে কম বেশি ভূত দর্শনের ভীতিও সংক্রমিত হয়েছে। ভূত দর্শনের ভয়ে, আমি ও আশিস নিতান্ত নিরুপায়। নাহলে রাত্রিবেলায় ন’টার মধ্যে বাড়িতে ঢুকে পড়ি! অবাক লাগত বাড়িওয়ালাদের কেউই কিন্তু কখনওই এই ব্যাপারে কথা তুলতেন না। ওনাদের সবাইকে আলাদা করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেছি। সবার সপার্ট উত্তর, সেরকম কোনও আওয়াজ শোনেনি। ওনাদের কোনও কারণে শুতে দেরি হলে আওয়াজটাও দেরিতেই হতো। আরেকটা কথা বলি ঘন্টি বাজানো, দরজার কড়া বাজানো আলাদা আলাদা মানুষের আলাদা রকমের হয়। তার রকমফের থেকে বোঝা যায়, দরজার ওদিকে কে দাঁড়িয়ে আছে। যেমন কেউ কড়া ফেলে জোরের সাথে, কেউ-বা খুব আস্তে করে। কড়া ফেলার স্পিডের সাথে তার আওয়াজও বদলে যায়, বলা বাহুল্য। সেই আওয়াজ আর জীবিত থাকতে সমীরদার গেট খুলে ঢোকার সময়ের গেটের কড়া ফেলার আওয়াজ ছিল এক-ই-রকম। আর প্রতিদিনই আমরা সেই একই রকমের আওয়াজ শুনতাম।

দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হলেন। সারাদেশে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ল। পাটনাতেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এই অজুহাতে লোভী মানুষের দল শিখদের দোকান লুটপাট শুরু করে দিল। চোখের সামনে বিহারি মালিকের দোকান লুধিয়ানা এম্পোরিয়ামও লুট হয়ে গেল। শহরে কার্ফু ঘোষণা হয়েছে। খাবারের দোকান সব বন্ধ, কাজকর্ম বন্ধ। বাড়িতে বসে টিভির দিকে চোখ খুলে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। কার্টুর প্রকোপে পড়ে আমার যেসব বন্ধুরা একা একা থাকত, তাদের বেশ কয়েকজন আমাদের বাড়িতে জায়গা নিল। কারণ আমাদের বাড়িটা বড়ো আর রুমমেট আশিস দারুণ রান্না করে।

কাজকর্ম নেই বাড়িতে ২৪ ঘন্টা ডু ফুর্তি পরিবেশ। রাত্রিবেলায় সবাই একসাথে হাতে থালা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেতে বসেছি, এমন সময় গ্রিলের গেট খোলার আওয়াজ এল। আশিস বলল, “শুনতে পেলি?” আমি বলি, ‘হুঁ, শালা ভূত কার্ফুতেও বেরিয়ে পড়েছে।’ গরম তেলে জল পড়ার অবস্থা। সবাই চেপে ধরল, ‘কী ব্যাপার? কী ব্যাপার?’ খাওয়া শেষ হলে, বলতে বসি ঘটনার আদ্যোপান্ত। সুধীর, আমাদের বন্ধু বলল, “গুরু! রসদ পেয়ে গেছি, এই রহস্য ভেদ না করে এখান থেকে যাওয়া নেই।”

ঠিক হল পরের দিন রাত্রি ন’টার পর থেকে আমরা ঝুলবারান্দায় বসব, ওখান থেকে গেটটা স্পষ্ট দেখা যায়। গল্প করব, হল্লা নয়, শুধু নজর থাকবে গেটের দিকে। জোগাড় হল আরেকটা বড়ো টর্চ। সেই অনুযায়ী রান্না সকাল সকাল সেরে এক ফ্লাস্ক চা ভরে আমরা পাঁচজন ন’টা বাজতেই বসলাম গিয়ে ঝুলবারান্দায়। সুধীরের কথামতো আমাদের ঘরের মেন দরজা খোলা রাখা হল। নীচু আওয়াজে আমাদের মধ্যে গল্প চলছে। কারওর আওয়াজ বেড়ে গেলেই তাকে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি গলার আওয়াজ আমারই। তাই দু-তিন বার বকা খেয়ে ঘাপটি মেরে চুপ করে বসে গেছি। এদিকে ঘড়ির কাঁটা দেখতে দেখতে ১০টা ছাড়িয়েছে। বাড়িওয়ালার বাড়ির লাইট অনেক আগেই নিভে গেছে।

তাপস বলল সুধীরকে, ‘যা একবার দেখে আয়, বাড়িওয়ালার মেন দরজা বন্ধ হয়েছে কিনা! আর কেউ সাথে যাবে না। তুই একাই যাবি। মেলা কপচেছিস, দেখি তোর সাহস।’ ইজ্জতের সওয়াল, সুধীর উঠল, তবে বীর পুঙ্গবের মতো নয়, কিছুটা অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির ছোঁয়া ওর মধ্যেও পৌঁছে গেছে। বললাম, “সিঁড়ির লাইট জ্বালাস না, টর্চ জ্বালিয়ে যা।”

কিছুটা গিয়েও সুধীর ফিরে এল। বলল, ‘গা ছমছম করছে মাইরি, কেউ একজন সাথে চল।’ সজল আর ও একই কোম্পানিতে চাকরি করে। সজল ওর সাথে গেল। কিছুক্ষণ পরে দু’জনে বীরদর্পে ফিরে এল। সজল বলল, ‘দরজা বন্ধ। হালকা ঠেলে দেখেছি, ঠেলা দিলে খুলছে না।”

রাত সাড়ে দশটা বেজেছে ঘড়িতে। আশেপাশের বাড়িগুলোর লাইটও নিভতে শুরু করেছে। পরিবেশ ধীরে ধীরে কিছুটা ভৌতিক হয়ে গেছে। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছে জীবনে প্রথম ভূত দেখার আগ্রহে। ১১টা বেজে গেছে, এবার তাপস ও সজলের ধৈর্য কমে এল। তাপস বলল, ‘সমীরদা আমাদের দেখে চলে গেছে। আজ কোনও তেঁতুল গাছে বসে রাত কাটিয়ে দেবে।’ আশিসের দিকে তাকিয়ে তাপস বলল, “আশিস আমি আর পারছি না, খাবারটা দিয়ে দে।’ সজল বলল, “তাহলে আমাকেও দিয়ে দে।’ ওরা দুজন খাবার নিয়ে ঘরের কেন্দ্রস্থলে রাখা টেবিলে বসে গেল। ওটা আমাদের ডাইনিং কাম ওয়ার্কিং টেবিল।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...