আমাদের আদি বাড়ি ছিল নবদ্বীপের ফুলিয়া গ্রামে। আমরা ছুটিছাটাতে ফুলিয়ার সেই বিশাল বাড়িতে সবাই যেতাম। কী ছিল না সেই বাড়িতে? সুপুরি গাছ আর নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা পুকুর। সেই পুকুরে ভর্তি চিংড়ি, পুঁটি, কাতলা মাছ। পেছনের বাগানে আম, কাঁঠাল, কামরাঙা, আতা গাছ ছিল।
আমরা জ্যাঠাইমা-জ্যাঠামশাই না বলে বলতাম বড়োমা আর বড়োবাবি। আমাদের একটিমাত্র জ্যেঠতুতো দিদি টুলটুলদি। সবার বড়ো ছিল সে। দিদি খুব সুন্দর দেখতে ছিল। সবারই খুব প্রিয় ছিল দিদি। খুব ভালো গল্প বলতে পারত। সন্ধে হলেই আমরা শুরু করতাম, “ও টুলটুলদি এসো না, গল্প বলবে।”
সূর্যদেব পাটে গেলেই আমরা দোতলা বাড়ির ঘেরাটানা বারান্দায় মাদুর পেতে বসে দেশ-বিদেশের কত গল্প শুনতাম। সন্ধ্যাবেলা টুলটুলদি যখন গল্প বলত, তখন বাড়ির হ্যাজাকের আলো দোতলার ঝুল বারান্দার দেয়ালে অদ্ভুত সব ছায়া তৈরি করত। সেই ছায়াগুলো হাওয়ায় এমন ভাবে নড়ত, মনে হতো যেন জীবন্ত মানুষ!
বড়োমার যমজ দাদারা আমাদের ফেলুমামা আর জিতুমামা। তাঁদের কাছেও ছোটোবেলায় অনেক মজার গল্প শুনেছি। ওনারা বিয়ে করেননি। শুনেছি ফেলুমামা ফেল করেননি জীবনে কিন্তু সবাই মজা করে ফেলুমামাকে ওই নামেই ডাকত। জিতুমামাও কোনও খেলায় জিততে পারতেন না। অদ্ভুত লাগে!
খুব মজার মানুষ ছিলেন ফেলুমামা আর জিতুমামা। অদ্ভুত সব হাসির ভূতের গল্প বলতেন।
অন্য কেউ হলে রাগ করতেন অথবা মনে দুঃখ পেতেন। কিন্তু ফেলুমামা আর জিতুমামার স্বভাবই ছিল একেবারে অন্য ধাঁচের। আমার নিজের কোনও মামা না থাকাতে ফেলুমামা আর জিতুমামাই আমাদের খুব প্রিয় মামা ছিলেন। ছুটিছাটাতে গেলেই ওনারাও চলে আসতেন তাই খুব জমজমাট আড্ডা আর হইচই হতো সারা বাড়িজুড়ে।
টুলটুলদির বিয়ের পর, দিদি ও অতীনদা বড়োমার কাছেই থাকত। কারণ বড়োবাবি মারা যাওয়ার পর ওই বিশাল বাড়িতে বড়োমার একা থাকা ভালো না ভেবেই টুলটুলদিরা থাকত। অতীনদারও কেউ কোথাও ছিল না, কাজেই কোনও সমস্যা হয়নি। তাতে বাড়ির সবাই খুব খুশি আর নিশ্চিন্তে থাকতে পারত।
গরমের ছুটিতে আমরা ফুলিয়াতে ছুটি কাটাতে যেতাম। খুব আম খেতাম, পুকুরে সাঁতার কাটতাম আর মাছ ধরতাম। আর টুলটুলদির কোল ঘেঁষে বসে নানান গল্প শুনতাম। তার মাথার জবাকুসুম তেল আর শরীরের তুহিনার সুবাসে এমন সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি হতো যে, আমরা কেউ দিদিকে ছেড়ে উঠতে চাইতাম না। একবার গরমের ছুটিতে গিয়ে দিদির কাছে এমন গল্প শুনেছিলাম, যা চিরদিনের মতো মনে থেকে গেছে। যার কোনও ব্যাখ্যা আজও ভেবে পাই না।
আমরা একটু বড়ো হওয়াতে টুলটুলদির সঙ্গে অতীনদার বিয়ের কয়েকবছর আগেকার সত্যি ঘটনা, টুলটুলদি গল্প আকারে আমাদের বলেছিল। আর বলেছিল এখনও স্পষ্ট মনে আছে, “শূন্য আকাশ থেকে কেউ খুঁজে দেখেনি কত সংঘাত থেকে ‘সাংঘাতিক’ হয় কিছু কিছু নাটকের দৃশ্য।”
অতীনদার মায়ের ইচ্ছে ছিল, একমাত্র ছেলে বিদেশে পড়তে যাবার আগেই তার বিয়ে দিয়ে দেবেন। ফলে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। অনেক সম্বন্ধ আসা শুরু হয়েছিল। সেই সম্বন্ধ দেখে চারিদিকে মেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ অতীনদার মা পড়ে গিয়ে কোমরে সাঙ্ঘাতিক আঘাত পান এবং কিছুদিন ভুগে শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান। ফলে মেয়ে দেখার ব্যাপারটা ওখানেই থেমে গেছিল এবং অতীনদাও লন্ডনে পড়তে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু অতীনদা না থাকলে কী হবে, পাত্রীপক্ষরা সমান আগ্রহে চিঠি দিতে লাগলেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে অতীনদার বাবা একেবারে একা হয়ে যাওয়াতে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। তাই পাত্রীদের অভিভাবকদের লেখা সেই সব চিঠির মধ্যে ইচ্ছে হলে কোনওটা তিনি খুলতেন আবার কোনওটা খুলতেন না। না খুলেই সেই অবস্থায় রেখে দিতেন।
এমনি করে প্রায় এক বছরের মাথায় অতীনদার বাবা হঠাৎ সেরিব্র্যাল অ্যাটাক হয়ে মারা গেলেন। তখন বাড়ির দায়িত্ব নিয়ে নকুলদা একা। অতীনদার ছোটোবেলা থেকেই নকুলদা ওই বাড়িতে আছে। সে-ই সংসার দেখতে লাগল।
কয়েক বছর পরের কথা। লন্ডন থেকে ব্যারেস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে অতীনদা চাকরি করছেন তাও প্রায় দু’বছর হয়ে গেছে। হঠাৎ অতীনদা কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছেন যে, কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটি মেয়ে তাঁকে অনুসরণ করছে। কখনও কোর্টের সামনে আবার কখনও বাড়ির সামনের গলিতে। এই ভাবে মেয়েটিকে রোজই প্রায় দেখা যেতে লাগল। একদিন মেয়েটি অতীনদার কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আমি কি আপনার সঙ্গে আপনার বাড়ির বৈঠকখানায় একটু যেতে পারি?”
অতীনদা ভাবলেন, মেয়েটির নিশ্চয়ই আইন সংক্রান্ত কোনও কিছু গুপ্ত পরামর্শ নেবার প্রয়োজন হয়েছে। তাই অতীনদা একটা নির্দিষ্ট দিন-সময় ঠিক করে তাকে আসতে বললেন। ঠিক সেই দিনে মেয়েটি এল। ঘরে ঢুকেই বিনা ভূমিকায় মেয়েটি অতীনদাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল, ‘আপনি বিয়ে করছেন না কেন? জানেন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবার আগ্রহ নিয়ে আমার বাবা আপনার বাবাকে আমার একটা ফটোসমেত চিঠি দিয়েছিলেন? আমার বাবা যা-ই করতেন, আমার মতামত ছাড়া কিন্তু তা কোনওদিন করেননি। সেই বিষয়ে আমি খুব ভাগ্যবর্তী বলতে পারেন। কিন্তু আপনার বাবা আমার বাবার চিঠিরও জবাব দেননি আর আমার ফটোটা ফেরত দেননি।’
(ক্রমশ…)