কাকলি অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও ভাবনাটা মগজে ক্রমাগত নাড়া দিতে থাকে। সে ভাবে, বাবা আজ দশ বছর হল নেই। বাবার চাকরিটাই মা পেয়েছে। মায়ের এখন বিয়াল্লিশ। আর্লি ম্যারেজ। মায়ের কুড়ি বছর বয়সে শ্রেয়া এসেছে মায়ের কোলে। তার মানে মায়ের বত্রিশ বছর বয়সেই যৌনজীবন স্তব্ধ হয়ে গেছে। রজো নিবৃত্তির দিল্লি তো এখনও অনেক দূর। কী আশ্চর্য! কী সাংঘাতিক অবিচার সংসারের! শ্রেয়া কোনওদিন মনের ভুলেও এসব ভাবেনি। অথচ ভাবা উচিত ছিল তার। তার জন্যই তো। সে-ই তো মায়ের পথের কাঁটা হয়ে আছে। সে না এলে তো মা অনায়াসেই ফের বিয়ে করতে পারত।

এর মধ্যে বার দুই শ্রেয়ার স্মার্ট ফোনের কালার স্ক্রিন কাঁপিয়ে সম্রাট ভেসে উঠেছে। অমনি ধকধক করে কেঁপেছে শ্রেয়ার বুকও। শ্রেয়া কাঁপা কাঁপা হাতে কানে ফোন তুলেছে। ওপার থেকে সেই আশ্চর্য রোমান্টিক কণ্ঠস্বর, ‘তোমার ব্যোমকেশ সমগ্র এনে রেখেছি।’

শ্রেয়া অনেক কষ্টে বলে, ‘আমি আসছি!’

শ্রেয়া এবার তড়িঘড়ি সব গুছিয়ে নিতে থাকে৷ কিন্তু তার মাঝখানেই আবার শ্রেয়ার মগজে খোঁচা দিতে থাকে মায়ের কথা। তার মায়ের প্রতি সংসারের অবিচারের কথা। মায়ের প্রতি তার অবিচারের কথা। শ্রেয়া শুনেছে, কুড়ি বছরের চৌকাঠ পেরোনোর আগেই ওর মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে।

ওর দাদু নাকি বলত, ‘মেয়েদের এত রূপ ভালো নয়।’ তাই বিএ পাশ করার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বছর না ঘুরতেই কনসিভ করেছে। শ্রেয়া এসে গেছে পেটে। বাবা চলে যাওয়ার পরেও একযুগ কেটে গেছে। সে ভাবে, তার মায়ের কোনও তুলনা হয় না। তার মায়ের ত্যাগের কোনও তুলনা হয় না।

শ্রেয়া ভাবে, তার মাকে হয়তো কেউ প্রোপোজ করেছে। মা বলেছে, না না অসম্ভব। আমার মেয়ে বড়ো হয়েছে। আমার পক্ষে এগোনো অসম্ভব। মায়ের হয়তো ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার জন্য স্রেফ তার জন্য, মা ইচ্ছের চুঁটি টিপে ধরেছেন। ছিঃ ছিঃ! এসব কথা তো তার কখনও মনে আসেনি। তখন ঠাট্টার ছলে বলা কথাটাকেই সত্যি করে তুলতে হবে তাকে।

আজ মা অফিস থেকে ফিরলে সে মায়ের গলা ধরে ঝুলে পড়বে। নিজের কথাও বলবে মাকে। মাকে বলতেই হবে। মাকে না বলে সে এই কঠিন ভাবনার বোঝা বয়ে বেড়াতে পারবে না। শ্রেয়া চিবুক শক্ত করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, সে আজ তার মাকে সব খুলে বলবে। বলবে, ‘আমাদের কলেজে সেমিনারে এসেছিলেন ভদ্রলোক। নাম সম্রাট মিটার। আই মিন মিত্র। তোমাকে কী বলব মা, লোকটা অসম্ভব রোমান্টিক আর কী অ্যাফেকশনেট লুক, যে কী বলব তোমাকে। যতবারই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে, ততবারই বুক ধক ধক করে কেঁপে উঠেছে।’

বাকিটা মাকে সে বলতে পারবে না। সে বড়ো লজ্জার নেহাতই মেয়েলি ব্যাপার। তার দেহনদীর চঞ্চল স্রোতধারা ফল্গুধারার মতো বয়ে গেছে। সেমিনারে ঝাড়া চল্লিশ মিনিট বললেন। আমার মনে হল, মাত্র চার মিনিট। উফ কী দুর্দান্ত ভয়েস মা। শুনলে তুমিও ফিদা হয়ে যেতে। আমি ফার্স্ট লুকেই ফিদা, হয়তো বুঝতে পেরেছেন। টি-ব্রেকের সময় আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই ছিলাম। অনুরাধা, পূজা ওরা আওয়াজ দিল। আমি তো ডোন্ট কেয়ার। লিস্ট বদারড। গেলাম ওঁর কাছে। আমাকে পাশে বসতে বললেন। আমি তখন আর আমার মধ্যে নেই। সারা শরীর আমার অবশ হয়ে গেছে। বললেন, ‘তোমার নম্বরটা দাও।’ আমি তক্ষুনি দিলাম। উনি বললেন, ‘মিসড কল দিলাম, সেভ করে নাও।’ না বললেও সেভ করতাম!

হ্যাংলার মতো তো বলেই বসলাম, ‘ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি?’

উনি বললেন, “নিশ্চয়ই। মোস্ট ওয়েলকাম। ফোন করে চলে এসো। সাহিত্য টাহিত্য পড়ো?’

—হ্যাঁ পড়ি।’

—ফেভারিট কে? শীর্ষেন্দু?

আমি বললাম, “আপনি ঠিক গেস করেছেন। তবে আমি একটু ব্যোমকেশ পড়তে চাই।

উনি বললেন, “ঠিক আছে তুমি যেদিন আসবে, ফোনে জানিও। আমি আনিয়ে রাখব। তোমায় প্রেজেন্ট করব কেমন?’

আমি বললাম, “ঠিক আছে।”

পরের দিনই আকাশ থেকে পড়ল শ্রেয়া। ফোনে সম্রাট মিত্র। ফোন কানে তুলে নেয় শ্রেয়া। সম্রাট বলেন, ‘তুমি আমার অফিসে আসছ তো?’

—হ্যাঁ যাচ্ছি তো।

কিন্তু শেষইস্তক আর যায়নি শ্রেয়া।

পরদিন আবার সম্রাটের ফোন পেল শ্রেয়া। বললেন, ‘এলে না কেন? ঠিক আছে তুমি একদিন আমার বাড়িতে চলে এসো।’ শ্রেয়া দমে যায়। তার মনে হয় ওনার বাড়িতে গেলে ব্যাপারটা একেবারেই জমবে না। শ্রেয়া ভাবে, প্রথম আলাপেই হুট করে বাড়ি চলে যাওয়াটা খুবই হ্যাংলামি হবে। তাছাড়া ওনার স্ত্রী থাকবেন। সে বড়ো অস্বস্তির ব্যাপার হবে। তাছাড়া নিজের সম্ভ্রমেও বাধছে। তার মনে হয়, সে যা ভেবেছিল, তা একেবারেই নয়। ওর প্রেমটা তাহলে একতরফা। নইলে উনি বাড়িতে চলে এসো বলবেন কেন?

সম্রাট শুনে বললেন, ‘আরে ধুর আমি বাড়িতে একাই থাকি। আমার স্ত্রী তিন বছর হল চলে গেছেন।’ শুনে শ্রেয়ার ভেতরটা ফের দুলে ওঠে। যেন খুবই দুঃখের ব্যাপার, কণ্ঠস্বরে তেমনই আপশোশ জাগিয়ে শ্রেয়া বলল, “ওহো! ইস, খুবই দুঃখিত আপনাকে দুঃখ দেওয়ার জন্য। কী হয়েছিল ওনার?’

—লাং ক্যানসার। একবছর ট্রিটমেন্টে চলল। তারপর আর ধরে রাখতে পারলাম না। আর আমাদের কোনও ইস্যুও হয়নি। শুনে শ্রেয়ার বুকের ভেতরটা আনন্দে তা তা থই থই করে দুলে উঠল। তার মানে উনি একা। ওদের মাঝখানে কোনও বাধার পাঁচিল নেই।

সম্রাট বলেন, “আমার লোনলিনেস আর হেল্পলেসনেসই এখন আমার জীবনের নিত্যসঙ্গী।’

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...