ঋষভ ঘর-জামাই হয়ে বাগবাজারে আছে। আর এখানে, বারাসাতে স্বামীর হাতে তৈরি নিজের বাড়িতে জীবনের শেষটুকু কাটাচ্ছেন মমতাদেবী। বিরাট বাড়ি। গাছ-পালা বেশি হওয়ায় অন্ধকার দিনেরবেলাতেও তাড়া করে বেড়ায় মমতাদেবীকে। নিঃসঙ্গতায় মন খারাপ হলে পাশের বাড়িতে যান, গল্প করেন। এখনও গ্রামে পাড়া-পড়শি বলে শব্দ চালু আছে। আর আছে কাজের মেয়ে লক্ষ্মী। সে-ই মেয়ের মতো হয়ে ঘর ভরিয়ে রাখে।
মমতাদেবী আজ লক্ষ্মীকে বলেছেন, বাজারে যাবেন। ছেলে-বউ-নাতনি-র জন্য পয়লা বৈশাখের জামা-কাপড় কিনবেন। তাড়াতাড়ি রান্না-বান্না সেরে নিতে হবে। তো সে মেয়ে বেশ মুখরা। রান্নাঘর থেকেই চ্যাচায়, “যে ছেলে-বউ-নাতনিরা খোঁজ-খবর রাখে না, তাদের জন্য আবার জামা-কাপড়! তোমার আদিখ্যেতা দেখলে আর বাঁচি নে।’
কী করবেন মমতাদেবী! ছোটো-বড়ো কথা তাকে সইতে হয়। এই কাজের মেয়ের উপরে তার ছিয়াত্তর বছর বয়সের জীবন অনেকটা নির্ভরশীল। আবার নিজের ছেলে-বউ-কে নিয়ে কেউ কটু কথা শোনালে মন থেকে মানতে পারেন না। অদৃষ্টকে দোষেন। আঁচলে চোখ মোছেন। লক্ষ্মী একটু বাদেই ডাকবে, ‘মা ভাত বেড়েছি, খাবে এসো।’
ছেলে, ছেলে-বউয়ের কাছ থেকে মা-ডাক শুনতে না পাওয়াটা পুষিয়ে দেয় লক্ষ্মী। মমতাদেবী জানেন লক্ষ্মী এক্ষুনি ডাকবে খেতে। আজ কেন যেন রান্না হতে বেশ দেরি হয়েছে। তিনি উঠোনের আমগাছের তলা ছেড়ে ঘরমুখো হলেন। এসময়ই ফোন বেজে উঠল। ছেলের ফোন। অনেকদিন বাদে ফোন করেছে। এখন কানে কম শোনেন।
ফলে ফোনের কালো রিসিভারটা কানের সাথে চেপে ধরলেন।
—কুন শিলের কথা কস? অয় অয়, ওই শিল আমার মায়ের, তাইন দিছলেন। মা-য় বিয়ের তত্ত্বের সাথে জোর করি পাঠায় ছেলেন। রাম-সীতার ছবি আঁকা ছেল। ওটা হবিগঞ্জের শিল।
ফোন রেখে মমতাদেবী একেবারে গোড়ায় ডুব দিলেন। মঙ্গলাচারণ হচ্ছে। শ্বশুড়বাড়ি থেকে সব লোকজন এসে পড়েছে। তিনি তখন কতটুকুই বা। খুব কৌতূহল। নিজেকে নিয়ে নয়, তাদের গাঁয়ের নতুন নতুন লোকজন, পোশাক-আশাক — সব ভালো লাগছে। খুব ইচ্ছে করছিল, চার-পাঁচ খানা ধামায় করে কী এনেছে ওরা, দেখে আসতে। কিন্তু তাকে সেসব করতে দিচ্ছে কোথায় ! মা এক বুক ঘোমটা টেনে দিয়েছে তার চোখের উপরে। সব আবছা আবছা। বাইরে উঠোনে কুঞ্জ সাজানো হয়েছে। সেখানে পঞ্চঘট। তার জল আমের পল্লব দিয়ে কন্যার গায়ে ছিটিয়ে তাকে বিশুদ্ধ করে তবেই পাত্রপক্ষের লোকেরা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান শুরু করবে।
মমতাদেবীর মা ছটফট করছিলেন। কতদিন আগেকার কথা। ঠিক মনে আছে। মা তো তাকে বুকের ভেতর চেপে ধরে রাখছিলেন, অন্য ব্যথায়। তার প্রাণের পুত্তলিকে মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে পরদেশে পাঠাতে হবে, তার আয়োজনে তিনি ছিন্নতা টের পাচ্ছেন। আর সে নিজে ছটফট করছিল কতক্ষণে বন্ধুদের নিয়ে পা-ছড়িয়ে বসে উপহার সামগ্রী দেখবে। ডালমুট খেতে খেতে গল্প করবে।
কুঞ্জে নিয়ে এসে তাকে একটা পিঁড়িতে বসানো হয়েছে। বিয়ের আগে শ্রীহট্টে এটাই প্রধান মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানেই কন্যার হাতে শাঁখা, কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর পরানো নিয়ম। ঠিক মনে আছে, তাকে পিঁড়িতে বসিয়ে দিতেই গোল হয়ে ঘিরে থাকা মেয়েরা গেয়ে উঠেছিল—
আসিল জনক রাজ করিতে মঙ্গল কাজ
স্বর্ণদান করিলেন যতেক ব্রাহ্মণে।
ওই যে পাকা কথা হয়ে গেল, তারপর তো আচার-অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। রূপসিপুজোর কথা মনে আছে তার।
বারান্দায় কাঠের চেয়ারে পা তুলে বসে স্মৃতির ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চাইছিলেন মমতাদেবী। ছেলে ফোন রেখেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু স্মৃতি তাঁকে ছাড়ছে না। রূপসি পুজোয় শেওড়াগাছের তলা ঝকঝকে তকতকে করে লেপে রাখা হয়েছে। নিজের বিয়ের অনুষ্ঠান। সেখানে যেতে নেই। জানলার লম্বা গরাদে মুখ ঠেসে ধরে যতটা সম্ভব দেখার চেষ্টা।
কলাপাতায় পাঁচ রকমের ফল রাখা আছে। আর একটা রেকাবিতে আছে ধান-দুর্বা, তেল- ল-সিঁদুর, কাঁচাদুধ, খই, আর দুটো পানের খিলি। চোখে পড়েছে তার মা প্রথমে সেই শেওড়াগাছকে ধান-দুর্বা, তেল-সিঁদুর আর পানের খিলি দিলেন। গাছের গুঁড়িতে তেল-সিঁদুর মাখালেন। তার পর অন্য এয়োতিরা। এরপর সাতপাঁকে রঙিন সুতোয় গাছ বাঁধা পড়ল।
দুই
—কত্তা, কামডা যখন দেলেন, একখান বিড়ি খাতি দেন। মনডা ফুরফুরে লাগতে আছে। কদিন পর পেরাণ লাচায়ে কাম করবানে। বাপ-পিতেমোরা আমার হাতের ভিতরি দে ফের ধরা দেবেনে। জানেন তো কত্তা, এই আমি কিচ্ছুডি না। তেনারাই আমার চাদ্দিকে ঘুরি বেড়ায়, আমারে দে আমার জীবনডারে বয়ায়ে নেয়। হাসায়, কাঁদায়। আমি খুব টের পাই।
ঋষভ মাথা নাড়ে। মনটা নরম হয়ে আছে তার। অনেকদিন পর মা-র সাথে কথা হল। মা-র গলায় কি কোনও কষ্ট ছিল! কষ্ট তো থাকবেই। একা একা থাকে বনের ভেতরে। কখনও মুখ ফুটে তো কিচ্ছুটি বলে না। কিন্তু মনের যন্ত্রণা কোথায় উবে যাবে! কুলাঙ্গার কুলাঙ্গার! মনে মনে নিজেকে গাল পাড়ে। যারে তুমি মর্তভূমি দিয়েছ, সে তোমারে তিলে তিলে মৃত্যুযন্ত্রণা দেয়। জন্মের পর মেরে ফেলতে পারোনি! ঋষভ নিজের চুলের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টান দিল। ব্যথা চাই তার। ঢের ব্যথা চাই।
ছোটো টিনের নস্যির কৌটো থেকে বিড়ি বের করে ধরানোর আয়োজন করল শিলকাটাইওয়ালা। সব কাজ তার গোছানো। সে বলল, ‘কত্তা, সাতমুখো আমার ঘর।’ গল্পের ঝাঁপি সে খুলে বসতে চাইল। বাইরে ঠা ঠা রোদ্দুর। এরকম নিরিবিলি ঠান্ডা জায়গা আজ আর হয়তো পাবে না।
—ক্যানো, ক্যানিং-এর নদীগুলো সব কোথায় গেল! ঋষভের অল্প অল্প ধারণা আছে। ওখানে মাতলা আছে, বাসন্তী আছে। সুন্দরবনের কাছাকাছি জায়গা।
শিলকাটাইওয়ালা দাঁতে বিড়ি চেপে কৌটো আর দেশলাই নিজের ঝোলার ভেতর ঢুকিয়ে রেখে বলল, ‘সে আছে কত্তা অনেক। মাতলা, বাসন্তী, বিদ্যেধরী, পিয়ালি, কুলতলি, ডুলিভাসানি গাঙ, রায়মঙ্গল, পাঠানখালি, কালিন্দি, হরিণভাঙা।’
বিড়িতে ঘন করে একটা টান দিয়ে চোখ বুজে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে আবার বলল, ‘ছোডোমোডো আরও কত যে ভারানি, দইনে নদী আছে!’
—এত নদী, তবুও বলছেন রুখাসুখা?
—বলতিছি কি সাধে! আমাগে বাড়ি ঠিক উলটো পানে। ওহানে নদী ক্যানো কোনও পুকুরও নাই। আশ্চর্যি বিধান বিধির। কিন্তু মাতলা নদীতে যদি বর্ষাকালে বান আসে, দেখপানে আমাগেও ভাসায় দেবেনে।
মা-র সাথে কথা বলার পর থেকে ঋষভের মন ভেসে আছে। মা-র মায়ের শিল এটা। মা তার মায়ের কথা বলার সময় উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছিল, আবার নিজের কথা বলার সময় গলা মিইয়ে গেছে। সবটা মিলিয়ে ঋষভ এখন নিজত্বে নেই। সে কেবল কথা চালানোর জন্য শুধোয়, ‘তা ওখানকার গাঁয়ের লোকজনদের চলে কী করে? সবাই শিলকাটার কাজে ঢুকেছে?’
—কী যে কন কত্তা! এই কামে অহন আর প্যাড ভরে! লোকে নানান কাম করে। ক্যানিং থে মাছ নে শহর পানে বেচতে আসে। ধানের জমিতে মজুরি দেয়, কাড়াল দেয়, মানে মাঝিগিরি করে।
(ক্রমশ…)