গর্ভাবস্থা এমন একটি পরিস্থিতি, যা প্রায় প্রত্যেক মহিলাকেই অনুভব করতে হয় কিংবা বলা যায় এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এটি মূলত একটি শারীরবৃত্তীয় অবস্থা, যেখানে শরীর ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান ভ্রূণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। আর এই গর্ভাবস্থায় মহিলাদের শরীরের সমস্ত ক্রিয়াকলাপে সুক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটতে পারে। তাই, এই সময় সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, গর্ভাবস্থায় মা যদি সাবধানে এবং সতর্ক থাকেন, তাহলে তিনি এবং তার আসন্ন সন্তান সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে পারবেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন কনসালট্যান্ট জিআই সার্জন ডা. সঞ্জয় মণ্ডল।

শিশুর আকার বৃদ্ধির সময় বর্ধিত জরায়ু ধীরে ধীরে পেটের গহ্বরের আরও বেশি জায়গা দখল করে এবং এর ফলে পরিপাকতন্ত্রের উপর চাপ পড়ে। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের ফলে গ্যাস্ট্রোসোফেজিয়াল জংশনের স্ফিঙ্কটার প্রায়শই শিথিল হতে থাকে। এর ফলে রিফ্লাক্স এবং বুকজ্বালার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, যা ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা অনুভব করেন৷ এই সমস্যাটি প্রাথমিক ভাবে লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন, বিছানার মাথার দিক উঁচু করে শোওয়া, খুব তৈলাক্ত এবং মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলা এবং কিছু সময়ের ব্যবধানে খাবার গ্রহণ করা ইত্যাদি।

বাড়িতে রান্না করা খাবার খাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ এই সময়। যেহেতু মায়ের নিজের এবং তার শিশুর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাই এই সময় চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া একটি ভালো বিকল্প। বিকাশমান ভ্রূণ ওষুধ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, তাই গর্ভাবস্থায় সমস্ত ওষুধ নিরাপদ বিবেচিত হয় না। অতএব গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।

বিশেষকরে গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে কোন ওষুধগুলি গ্রহণ করবেন, সেই বিষয়ে খুব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ এটি এমন সময়, যখন বিকাশমান ভ্রূণ ক্ষতিকারক ওষুধের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। তবে সুসংবাদটি হল যে, বেশিরভাগ ওষুধ যা আমরা সাধারণ অসুখে ব্যবহার করি, সেগুলি সাধারণত নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়। তবে সর্বোত্তম উপায় এটাই যে, প্রতিটি হুবু-মায়ের সতর্ক থাকা উচিত এবং তিনি যে ওষুধগুলি গ্রহণ করতে চান, সে সম্পর্কে প্রসূতি বিশেষজ্ঞকে জানিয়ে ব্যবহার করা উচিত।

রেনিটিডিনের মতো ওষুধগুলিকে গর্ভাবস্থায় নিরাপদ বলে মনে করা হয়। তবে বেশিরভাগ পিপিআই, যা আজকাল ব্যবহার করা হয়, সেগুলি সাধারণত নিরাপদ। পিপিআই-এর মধ্যে ল্যাঞ্জোপ্রাজল সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করা হয়। তবে সবচেয়ে ভালো উপায় হল, আপনার যদি কোনও সমস্যা না হয়, তাহলে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খাবেন না।

কোষ্ঠকাঠিন্য হল আরেকটি সমস্যা, যা গর্ভাবস্থায় সাধারণত ১১ থেকে ৩৮ শতাংশ হবু মায়েরা এই সমস্যায় পড়েন। এটি মূলত গ্র্যাভিড জরায়ু গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বড়ো অস্ত্রের উপর চাপ দেয়।

এটি উপশম করার সর্বোত্তম উপায় হল প্রচুর পরিমাণে তরলযুক্ত খাবার, শাকসবজি, স্যালাড, ফল এবং অন্যান্য উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। তবে মনে রাখবে, তরল পানীয় মানে সফট-ডিংক্স নয় কিংবা কোনও সিন্থেটিক জুস নয়। তরল খাদ্য বলতে এখানে বুঝতে হবে ফলের রস। এই সময় শারীরিক কার্যকলাপ স্বাভাবিক রাখুন, তবে সাবধানতা অবলম্বন করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হালকা কিছু ব্যায়াম করতে পারেন এই সময়।

পেট ফাঁপা বা গ্যাস-এ পেট ফুলে যাওয়া গর্ভাবস্থায় খুব খারাপ হতে পারে এবং এটি মূলত হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয়। এই সময় গ্যাসের সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম উপায় হল হালকা কিছু ব্যায়াম, তবে তা চিকিৎসকের থেকে জেনে নিয়ে অভ্যাস করুন। এই সময় খাবার খেতে হবে ধীরে ধীরে অর্থাৎ সময় নিয়ে। সেইসঙ্গে, সঠিক পরিমাণে জল পানও করতে হবে। তবে এই সময় কার্বোহাইড্রেটযুক্ত পানীয় এড়াতে হবে এবং তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া বন্ধ করতে হবে। আর যদি এই উপায়গুলি কার্যকরী না হয়, তাহলে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।

গর্ভাবস্থায় আইবিডি বা Irritable bowel disease হল আরও একটি সমস্যা, যা হবু-মাকে এবং তার গর্ভের সন্তানকে বিপদে ফেলতে পারে। এই পরিস্থিতির থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে আপনার চিকিৎসক উপযুক্ত ওষুধ দিতে পারেন, যা নিয়ম মেনে খেতে হবে।

হরমোনের পরিবর্তনের ফলে গর্ভাবস্থায় পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যা পিত্তের লিখোজেনিসিটি বাড়ায়। পিত্তথলির স্লাইডের ঝুঁকি ৩১ শতাংশ এবং নতুন পাথর হওয়ার ঝুঁকি আরও ২ শতাংশ। গর্ভাবস্থায় ব্যথা, ডিসপেসিস এবং অন্যান্য জটিলতা হতে পারে হবু-মায়ের। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আপনার একজন জিআই সার্জনের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। বারবার একই উপসর্গ দেখা দিলে রোগীর কোলেসিস্টেক্টমি করা উচিত, যা দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের সময় সবচেয়ে নিরাপদ।

অ্যাপেনডিসাইটিস হল আরও একটি খুব সাধারণ রোগ যা গর্ভাবস্থায় বৃদ্ধি পায় না, তবে যদি এটি ঘটে তাহলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে সমস্যার সমাধান করবেন চিকিৎসক।

প্রথম ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে কোনও সার্জারির প্রয়োজন হলে ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতিতে করা যেতে পারে। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের সময় অস্ত্রোপচার সবচেয়ে নিরাপদ কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে মা এবং সন্তান উভয়ের ক্ষেত্রেই ঝুঁকি হতে পারে। অবশ্য পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞ এবং জিআই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চললে সবরকম সমস্যা কাটিয়ে ওঠা অনেকটাই সম্ভব হবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...