ঋষভ কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ে। এটা ওর স্বভাব। মনে হয় যদি ভুলে যায়। তাই তো তক্ষুনি তক্ষুনি বলা চাই। এতে যে অশান্তি হয় তা সে জানে। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারে না। ঋষভ শিলকাটাইওয়ালার কথার মাঝে ঢুকে পড়ে জিজ্ঞাসা করে, “তা আপনার চলে এ কাজে? বাড়িতে ক’জন খোরাকি? কেমন আয় হয়?’

একগাদা প্রশ্ন করে নিজে নিজে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়। এখন যদি লোকটা কাঁদুনি গাইতে শুরু করে। আর শিলকাটার মজুরি দ্বিগুন চায়! তার কেবলি মনে হয় লোকজন তাকে ঠকাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। যে যেখান থেকে পারে, তাকে ঠকায়।

শিলকাটাইওয়ালা অবাক চোখে চায়। তারপর মাথা নীচু করে। তার কাঁধ ঝুলে পড়ে। ‘সত্যি কথা বলি কত্তা, চলতি চায় না। মা আর বউ দুজনেই বিড়ি বাঁধে। কখনও ধানের জমিতে কামিন খাটে। কখনও মাছ ধরতি যায়, কাঁকড়া ধরতি যায়, হোগলার চাটাই বুনে বেচে।’

—এই কাজ থেকে কেমন আয় হয়?

—তা কী আর আয় হবে কত্তা! একবার শিল কাটালি তো কয়েক বচ্ছর নিশ্চিন্তি। তা ছাড়া এখন অনেকে প্যাকেটের মশলা খেতি লেগেছে। বাটনা বুটনির তালে থাকতি চায়নে।

–দিন দিন তো আরও খারাপ হবে। তখন আপনি কী করবেন? অন্য কাজ দেখে নিন এই বেলা। বলার পর পরই ঋষভের মনে হল,লোকটা যদি অন্য কাজে যেত, তাহলে সে শিলকাটাইওয়ালা কোথায় পেত! তখন তো তার নিজেরই বিপদ হতো।

—কী কব কত্তা, আমারই গোয়ার্তুমি! আমাগে ওখানে কত লোকে কত কী করে! নদীতে ফেরি নৌকো চালায়। মউলি-র কাম করে। সেদিন তো দেহি কালু বাগদি কলকাতার পথে রিকশা টানতিছে।

সে কথা থামায় না। শিলের উপর ঠুকুর ঠুকুর করতে করতে ছবি ফোটায় আর বলে চলে, “ওরা কত কতি থাকে, শহরে আর এ কাজ পাবিনে রে দীনু, চলি আয় আমাগে সাথে। কিন্তু কত্তা, আমার ওই এক জেদ, বিশ্বকর্মার ইচ্ছেয় আমার বাপ-পিতেমোর শেখা শিল্প আমি নষ্ট করি ফ্যালবো! আমার বাপ আমারে হাতে ধরি শিল কাটা শেখায় ছেল। তার খুব নাম। লোকে কতো আমার বাপ তো শিল কাটে না, পাথরের বুকি আলপনা দেয়। তার ছেলে হয়ে কেমনে আমি ছাড়ি ছুড়ি দিই কন! প্যাডের খিদের জন্যি মনের খিদেরে মারি ফেলব!’ শিলকাটাইওয়ালার গলার স্বর ভেঙে আসে। তার অসহায়তা নজরে পড়ে ঋষভের।

এই অসহায়তাই তো তাকে গিলে খাচ্ছে। জুটমিলের চাকরিটা চলে যাবার পর ঋষভ কেবলই ভাবে, মরে গেলে ভালো হতো। সে তো হোমেও লাগছে না, যজ্ঞেও না। বাড়ির কোনও কাজই সে গুছিয়ে করতে পারে না। আবার মাকে নিজের কাছে এনেও রাখতে পারে না বউ-এর ভয়ে। মার কাছেও তার কোনও মূল্য নেই। আর এ বাড়িতে নিজের মূল্যহীনতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না। এমনি করে বাঁচায় কী লাভ!

শিলকাটাইওয়ালা তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঋশভ চেয়ারে বসে কিছুই দেখছে না ওই পাথর ও বাটালির সংগ্রাম। সে আছে নিজের ঘোরের মধ্যে। মাঝেমধ্যে অবশ্য শিলকাটাইওয়ালার কথা কানে বাজছে।

—জানেন কত্তা, এক সালে আমার ভায়রা আমারে জোর করি নে গেল মাঠের কাজে। সেখানে ধানের চারা রুইতে হতো। পায়ের নীচি জল, আর মাথার পরে রোদ্দুর। দুদিক থে কামড়। শ্যাষ করতি পারলাম নি। উদোম জ্বর। সেই ভায়রাই ট্যাকের কড়ি খরচ করি ওষুধ-পথ্যি কইরল। কিন্তু কিছুতেই সে শালোর জ্বর নামে না। শ্যাষে বিরক্ত হইয়ে আমারে বাড়িতে ফিরায়ে দেলি জ্বর বাপ বাপ করি পগার পার।

শিলকাটাইওয়ালার চার চারটে বাটালি কাজে নেমে পড়েছে। ভারী মোটা বাটালি রেখে সে এবার নরুণের মতো একটা নিয়ে লেগেছে। ছোটো ছোটো রেখার কাজ। নাক, মুখ হাতের গড়ন পুরুষ ও মেয়ের আলাদা আলাদা হবে। সেই সূক্ষ্ম কাজে ধৈর্য আর বাটালির উপরে হাতুড়ির ঘা মাপ মতো হতে হবে। কোথাও পাথরের বুক থেকে বেশি করে চলটা উঠিয়ে ফেলা যাবে না।

শিলকাটাইওয়ালার হাত চলছে বলে মুখ থেমে থাকেনি। সে বলে চলেছে, ‘কত্তা, আজ যা প্রাণে আনন্দ পাতিছি তা মেলাদিন পাইনি। কলকেতায় রাস্তায় রাস্তায় সারাদিন ঘুরি। সাধারণ শিল সব। তাতে তো রূপ ফোটাতে লাগে না। এক বাটালিতেই চলি যায়। তাতে যা হয়, চাল কিনি, সবজি কিনি — বাঁচি। কিন্তুক বাঁচার মতো বাঁচি নে।”

এই ‘বাঁচার মতো বাঁচি নে’ শব্দ ক’টি ঋষভের কানে ধাক্কা মারে। সে নিজের মনেই, হয়তো একটু জোরেই স্বর ফেলে, “বাঁচার মতো বাঁচাটা আবার কী!”

শিলকাটাইওয়ালা তার কাজ না থামিয়েই বকে, ‘কত্তা, ওই যে কতিছিলাম না, ধান রুইতে গে জ্বর এল। তা অন্য কামিনদের তো আসে নাই। যে-ঘরামি দিনভর রোদে পুড়ে ঘরের চাল ছায়, আবার বৃষ্টি আলি জলে ভেজে, কই তার তো জ্বর আসে নে। তয় আমার হল ক্যান!”

পাথরের বুকে মৃদু ঠুন ঠুন ধ্বনি উঠতে থাকে। সে শিল একটু একটু নাড়ায়, নিজের কোলের দিকে টানে। কিন্তু ঋষভ এই দেখাটা দেখছে না। সে দেখছে, মানে দেখতে চাইছে, জ্বর আসছে কীভাবে! ভেতরে ভেতরে সে বলছে, বল বল জ্বর এল কেন!

—কত্তা, আমাগে পালপাড়ায় দেবী দুগ্‌গোর পুজোর আগে আমি দেখতি যাই, কেমন করি পালেরা ঠাকুর বানায়। এই পেল্লায় পেল্লায় মায়ের মূর্তি। কত মূর্তি সারি দেয়া। একখানা গড়তেই মানুষের একজীবন কাটি যাবার কতা। তো সে কোতা থেকি এত খ্যামতা পায়! এক একখান দেবীর দিকি চালি আর নজর ফেরাতি পারি না। কী মায়া, কী আলো, কী অবাক পারা ভালোলাগা সব মুখে মুখে! কত্তা, কন তো সে ওই দেবতার দেবতা হতি পারল তো!

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...