তৃষাকে বাঁচানো যায়নি। পিনাকি কিন্তু বেঁচে গিয়েছিল। ঝরনামাসি আর মেসো পিনাকির টাকার কাছে চুপ করে গিয়েছিল। ছোটো মেয়ে তিস্তাকে বিনা পণে এমন ওজনদার পাত্রর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া স্বপ্নের মতো। তৃষা মরে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে তার পরিবারকে। পিনাকিদাকে মেনে নিতে আপত্তি ছিল না তিস্তার, সে শুধু বলেছিল তিতলির দায়িত্ব সে নেবে না। ঝরনামাসি আর মেসোর কাছে আপাতত তিতলি আছে। একটু বড়ো হলে ওকে হস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
—তিস্তা কেমন আছে মাসি? পিনাকি ওর গায়ে হাত তোলে না তো?
—হাত তুলবে কী রে! সোনার টুকরো ছেলে। তিস্তাকে দামি পোশাক গয়নায় মুড়ে রেখেছে। এই তো সুইজারল্যান্ড যাবার টিকিট, হোটেল বুকিং সব হয়ে গেছে।
—তিস্তা ভালো আছে তো মাসি?
—তোর বুঝি ওর ভালো থাকায় আপত্তি? কী শুনতে চাস বলতো? তৃষা নিজেই জেদি ছিল। মেয়েদের একটু আধটু মানিয়ে নিতে হয়। তিস্তা আমার বুদ্ধিমতী মেয়ে।
ফোনটা রেখে সোনালি বারান্দায় দাঁড়াল। তিস্তা ভালো আছে এটা মানতে অসুবিধা হচ্ছে কেন তার? নাহ বড্ড বেশি সে সবকিছুর মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুদিনের জন্য বাইরে চলে যেতে হবে। এবার সে সমুদ্রে যাবে। কোথাও ঘুরবে না, খাবেদাবে আর হোটেলের রুমে শুয়ে থাকবে। শুধু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় বাইরে বেরোবে। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট আর হোটেল বুকিং সেরে নিল। তাজপুর আগেও গেছে, বেশ নির্জন সৈকত, নিজের মতো ক’টা দিন কাটাতে পারবে।
—আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে, কোথায় দেখেছি বলুন তো? ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সোনালি ভদ্রলোকের দিকে তাকায়, আর তারপরেই কেঁপে ওঠে। পার্থদা এখানে? এভাবে নির্জন সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্তের সিঁদুরে রঙে মাখামাখি হতে হতে পার্থদার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি সোনালি।
—ওদিকটায় একটু বসবে সোনালি? ভ্রাম্যমাণ চা-ওয়ালাকে ডেকে দু ভাঁড় চা নিল। সোনালির এ ধরনের চা খাওয়ার অভ্যাস বহুদিন গেছে। সে ইলেক্ট্রিক কেটল আর পছন্দের টি ব্যাগ ক্যারি করে বাইরে গেলে। এখন আপত্তি না জানিয়ে এই দুধে ফোটানো চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিল। পার্থদা গভীর দৃষ্টিতে তাকে দেখছিল।
—তোমার এমন চা খাবার অভ্যাস নেই, না?
সোনালি উত্তর দেয় না। অশান্ত হাওয়ায় তার চুল এলমেলো হয়ে যায়। পার্থদা কী যেন একটা বলতে চেয়েছিল! ঝুনুদি বারবার বলেছে, এমনকী তার ফোন নাম্বারটাও দিয়েছে। সোনালি সমুদ্র থেকে চোখ ফিরিয়ে পার্থদার চোখে চোখ রাখল। পার্থদার নীলচে মণিও সমুদ্রের মতোই অশান্ত।
—পার্থদা তুমি মনে হয় আমাকে কিছু বলতে চাও?
—হ্যাঁ বলব তো। তার আগে অন্য একটা কথা বলি, ঝুনু বলছিল তোমার এক কাজিনের মেয়েকে অ্যাডপ্ট করতে চাও। তোমার তো তেতাল্লিশ চলছে, একা এই বয়সে এত ঝক্কি সামলাতে পারবে?
সোনালি অবাক হয়ে যায়। এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, এ ব্যাপারেও ঝুনুদি বাইরের লোকের সঙ্গে আলোচনা করে! উফ ঝুনুদিকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না, জাস্ট আনটলারেবল। সোনালির মুখে অসন্তোষ ফুটে উঠতেই পার্থ চুপ করে যায়। অন্ধকার নেমে আসছে, দোকানপাট বন্ধ হয়ে আসছে। সোনালি উঠে পড়ে। দেখাদেখি পার্থদাও।
—কাল আমি চলে যাব, জানি না আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে কিনা! কথাটা বলার সুযোগ পাব কিনা! অন্ধকার থাকায় পার্থদার সুবিধাই হল।
—সেদিন আমি ইচ্ছা করেই তোমাকে… আসলে ঝুনুর সঙ্গে যত জড়িয়ে পড়ছিলাম তোমার প্রতি আকর্ষণ ততই বাড়ছিল। হিসহিস করে উঠল সোনালি, ‘ঝুনুদি জানে? আমার থেকে তার একথাটা জানা বেশি দরকার।”
—হ্যাঁ জানে। জানে বলেই তোমাকে নিয়ে এত ভাবছে, তোমার জীবনটা অন্য কারুর সঙ্গে জড়িয়ে দিতে চাইছে, এভাবে একা বাঁচা যায় না সোনালি। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারো না?
হনহন করে হেঁটে যায় সোনালি। আলো ঝলমলে হোটেলের গেটটা দেখা যাচ্ছে। পার্থদার গায়ে অন্ধকারের মোটা পরদা। যত অন্ধকার ক্লাস নাইনের একটা মেয়ের গায়ে মাখিয়ে দিয়েছিল তার শতগুণ ফিরে এসেছে তার কাছে আজ এই সামুদ্রিক হাওয়ায়।
ঝুনুদি এসেছে পিন্টুর বাড়ি। ফোনে কথা হয়। আজকাল আর পার্থদার ব্যাপারে কথা তোলে না। অথচ সোনালি যেন অনেক কিছু শুনতে চায়। তিতলিকে অ্যাডপ্ট করবে মনস্থির করে ফেলেছে। শুধু মাঝেমাঝে রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে দুশ্চিন্তা হয়, সে একা হাতে পারবে তো সবকিছু সামলাতে। খুব ইচ্ছা করে কেউ কেউ এগিয়ে এসে শক্ত করে হাতটা ধরুক।
—জানিস আবার জন্মদিন পড়ছে ক’দিন পরেই। পিন্টুর বউ তো সেই নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে। নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছে। দুপুরে পঞ্চব্যাঞ্জন, পায়েস সব নিজের হাতে বানাবে। রাত্রে বাইরে ডিনারে নিয়ে যাবে। তুই বল এ বয়সে এইসব মানায়! কিন্তু পিউ শুনলে তো! আহ্লাদে গলে পড়ে ঝুনুদি।
সোনালি হিসেব করে নেয়, ওইদিন শনিবার। ঝুনুদি খুব শাড়ি ভালোবাসে, একটা শাড়ি কিনবে ঝুনুদির জন্য। আর নিজের হাতে একটা কেক বানিয়ে নিয়ে যাবে।
সোনালি বলে, “তার মানে সন্ধেটা বার্থডে গার্ল ফ্রি থাকবে?”
মুখ ঝামটায় ঝুনুদি, ‘এই তুই আর ন্যাকামি করিস না তো!”
কেকটা মনের মতো বানিয়েছে সোনালি। পিন্টুর ঠিকানা তো ঝুনুদির কাছে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সন্ধে সাতটার দিকে পৌঁছে গেল। দরজায় চাপ দিতেই সেটা খুলে গেল। ভিতরের ঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, ‘তোমার মায়ের কী দরকার ছিল বুড়ো বয়সে জন্মদিন, জন্মদিন করে আদিখ্যেতা করার? গুষ্টিশুদ্ধ আত্মীয়স্বজন সকাল থেকে ফোন করেই যাচ্ছে। আর জিজ্ঞেস করছে, সন্ধেটা তোমরা বাড়িতেই থাকছ তো? উনি তো নিজের ফোন বন্ধ করেই খালাস। যত ফোন ঢুকছে আমার মোবাইলে। পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। এই আমি বলে দিলাম কেউ এসে পড়লে আমাকে ডাকবে না।”
সোনালি ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। ঝুনুদির জন্য কেনা শাড়ি আর ফুলের বোকেটা সেন্টার টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে। কী মনে হতে কেকের প্যাকেটটা সঙ্গে করে নিয়ে আসে। ফেরার পথে চিলি চিকেন আর ফ্রায়েডরাইস প্যাক করিয়ে নিল। বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল। পাটভাঙা একটা শাড়ি পরে ডিনার টেবিল সাজাল। অনেকদিন আগে কিনে রাখা সুগন্ধী মোমবাতিগুলো জ্বালাল। দামি ক্রকারি সেটটা বার করে খাবার সাজাল। তারপর কেকটার বুকে মসৃণ ভাবে ছুরি চালাল। চকোলেট কেকের একটা টুকরো নিজের মুখে তুলে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল, ‘হ্যাপি বার্থডে টু মি।’
হ্যাঁ আজ তার জন্মদিন, অনেক কিছুর মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছিল সে। আজ বুঝতে পারছে এই বেশ ভালো আছে। তার একলা জীবন আলোকিত হয়ে উঠুক, এই একলা থাকার জন্মদিন আজ, কাল আর প্রতিটা দিন।
(সমাপ্ত)