ছোটো ঠাকুরদা। আমাদের পরিবারের ছোটো ছেলে। বিবাহ করেনি। ছোটো ঠাকুরদার ঘরের কিছু বাড়তি মরচে ধরা লোহার জিনিসপত্র তাঁর নির্দেশে বিক্রি করছিলাম। আদতে আগামীকাল ঠাকুরদার জন্মদিন। তাঁর ঘরে ইতিমধ্যেই নতুন জিনিসপত্র রাখার অভাব হয়ে পড়েছে। তাই ব্যবহারজীর্ণ জিনিসপত্রগুলি বিক্রির দায়িত্ব আমার উপরেই এসে বর্তেছে। সেগুলোর মধ্যে ছিল একটা মরচে ধরা ট্রাঙ্ক। সেটি খুলে তার মধ্যে থেকে ডায়ারি, খাতা, পেন এবং একটি প্রেমের গল্পের বই খুঁজে পাই।
বইটা বেশ জব্বর লাগল। প্রেমের ক্ষেত্রে হয়তো কাজেও লাগতে পারে। তাহলে সোনালির সঙ্গে আমার প্রেমটা আরও মজবুত হয়ে উঠবে। কাজেই বইটি এবং বাকি জিনিসগুলো নিজের কাছে রেখে ট্রাঙ্কটা বিক্রি করে দিলাম। সবমিলিয়ে যা টাকা-পয়সা পেলাম, সবটাই ঠাকুরদার হাতে ধরিয়ে দিলাম। ঠাকুরদা বলল— টাকাগুলো নিজের কাছে রাখতে। জন্মদিনের সরঞ্জাম কিনতে কাজে লাগবে। তখন বললাম, “আমি থাকতে তোমার এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার কোনও দরকার নেই। তুমি একলা মানুষ। টাকাগুলো তোমার বেশি দরকারে লাগবে।’ তবুও ঠাকুরদা আমার হাতে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নিজের জন্য না লাগুক, অন্তত সোনালিকে একটা চকলেট কিনে দিস। ও বড়ো ভালো মেয়ে। কখনও ওকে কষ্ট দিবি না।’
আমি মাথা চুলকে একটু মুচকি হেসে ঠাকুরদার ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে প্রেমের গল্পের বইটা হাতে নিয়ে বসে যাই। প্রথম যে গল্পটি পড়লাম, তা খানিকটা এই রকম— গল্পের নায়ক, নায়িকাকে বড়ো ভালোবাসত কিন্তু মেয়েটি তাকে ভালোবাসত না। সে আবার অত্যন্ত সুন্দরী বলে মনে মনে বেশ অহংকার বোধ করত। একটি ছেলেকে সে ভালোবেসেও ফেলেছিল। তারপর যখন সে জানতে পারে ছেলেটি বহু মেয়ের সঙ্গে প্রেমলীলা চালিয়েছে এবং বর্তমানে একজনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যুক্ত, তখন তার ভুল ভাঙে। এদিকে গল্পের নায়ক সেই মেয়েটিকে ছাড়া অন্য কোনও মেয়েকে তেমন পাত্তা দিত না। কাজেই শেষপর্যন্ত তাদের মিল হয়েছিল।
গল্পটি পড়ার পর মনে মনে ভাবলাম, বাব্বা, ভাগ্যিস সোনালিকে পেতে আমায় এত কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এর পরের গল্পটা পড়তে গিয়ে হঠাৎ সাদা-কালো পোস্টকার্ড সাইজের একটি মেয়ের ছবি খুঁজে পাই। ছবিটি দেখেই তৎক্ষণাৎ মনের মধ্যে একটা কৌতূহল জন্মাল। এই ছবি এমনি এমনি কখনওই বইটির মধ্যে থাকতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই ঠাকুরদার ঘরে। তারপর মেয়েটির ছবি তাকে দেখিয়ে বললাম, “এই মেয়েটি কে ঠাকুরদা? তুমি কি এনাকে চেনো?”
ছবিটি হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত সেটি দেখে ঠাকুরদা বলল, ‘এই ছবি তুই কোথায় পেলি?”
ঠাকুরদাকে বললাম সমস্ত কথা। তা শুনে সে চোখ থেকে চশমা খুলে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। তারপর বলতে শুরু করল— সে বহুকাল আগের কথা। আমি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তাম। কলকাতার বাড়িতেই থাকতাম বাবা-মায়ের সঙ্গে। প্রায় নিয়মিত কলেজ যেতাম। তবে যে শুধুই পড়াশোনার জন্য, তা নয়। আমরা চার বন্ধু মিলে আড্ডা মারতাম। আমি, অজিতেশ, বিপিন আর সঞ্জয়। ছুটির পর আমরা একসঙ্গে ট্রামে চেপে বাড়ি ফিরতাম। আমরা একসঙ্গে অনেক নাটকও দেখেছি। তবে এরই মাঝে হঠাৎ একদিন আমাদের কলেজে একটি মেয়ের লেট অ্যাডমিশন হয়। ওর নাম ছিল প্রিয়াঙ্কা। মেয়েটি খুব নম্র, শান্তশিষ্ট গোছের। প্রথম দিনই ও আমার পাশে এসে বসেছিল, সেদিনই ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। আমরা চার বন্ধু তখন কী বিষয় নিয়ে ইয়ার্কি ঠাট্টা করছিলাম, তা মনে নেই। কিন্তু ও পাশে এসে বসতেই আমরা চুপ করে গিয়েছিলাম। একটা সময় ও যখন আমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করল, তখন পাশ থেকে সঞ্জয় আমার কানের খুব কাছে চাপা কণ্ঠে বলল, দেখেছিস, মেয়েটা আজ প্রথমবার ক্লাসে এসেই তোর সঙ্গে কেমন ভাব জমিয়ে নিল। এটাই প্রেমের প্রথম লক্ষণ।
সঞ্জয় এমনিতেই মজা করতে খুব ভালোবাসত। তাই ওর কথায় তেমন আমল দিইনি। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর কথাই যে বাস্তবের রূপ নেবে, তা পূর্বে আন্দাজই করতে পারিনি। আসলে প্রেম, ভালোবাসার প্রতি আমার কোনওদিনই উৎসাহ ছিল না। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসে আড্ডা মারা, ছুটির সময় বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা, এগুলোই আমার জীবন ছিল। কিন্তু তারই মাঝে প্রিয়াঙ্কা যে কীভাবে একটু একটু করে আমার মনে বাসা বেঁধে ফেলেছিল, তা কোনওভাবেই বুঝতে পারিনি। সে সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত। ছুটির পরেও আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরতে চাইত। কিন্তু আমি মানা করতাম। বলতাম আমার বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি ফিরতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এমনিতেই সেই সময়ে কলকাতার রাস্তায় এমন দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে থাকত যে, ওকে একা ছাড়তেও কুণ্ঠাবোধ হতো। তবুও আমি মন থেকে ওকে এড়িয়েই যেতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু একদিন কলেজ ছুটির পর সামনের ফুটপাতে রীতিমতো প্রবল সংঘর্ষ শুরু হয়ে হল। সেইসঙ্গে গুলি বর্ষণ। আমাদের চোখের সামনে একটি জলজ্যান্ত যুবককে খুন হয়ে যেতে দেখেছিলাম। আমাদের সকলের মনে তখন চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।