দার্জিলিং জেলার একদম সমতলে অবস্থিত খড়িবাড়ি নামক স্থান। এখানকার অধিকাংশ মানুষই বিত্তবান। তাদের চালচলনেই মনে হয় এই জায়গায় চাকুরিজীবী লোক যেমন আছে, তেমন আছে ব্যবসায়ী, সম্পন্ন কৃষক, জোতদার থেকে বিভিন্ন পেশার ধনী লোক। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল এখানে এক অশান্তি সকলকে খুব চিন্তায় রেখেছে। বেড়েছে পেশাদারি চোরের উৎপাত। একেকটা ভয়ানক চুরির ঘটনা মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। স্থানীয়রা চুরির ঘটনায় আতঙ্কে রাতে বিছানায় বল্লম, বড়ো হাত-দা, লাঠি নিয়ে শোয় — যা ক্রমে স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
পাড়ার মোড়েই নাকি খবর পেয়ে যায় চোরেদের গ্যাং। কোথায় কোন অনুষ্ঠানে বেড়াতে গিয়েছে এলাকার মানুষজন বা কোন বাড়ির লোক ভ্রমণে গিয়েছে দূরে কোথাও, কারাই বা হেল্থ চেকআপে গিয়েছে রাজ্যের বাইরে। তারপর সুযোগ বুঝে ওই ফাঁকা বাড়িতে বা অন্য কারও ঘরে চুরির প্ল্যান তৈরি করে, প্রস্তুতি নিয়ে চোরেরা প্রবেশ করে। অপারেশন চলে প্ল্যানমাফিক রাতভর। কিন্তু আশেপাশের লোকজন কোনও কিছুই টের পান না ওই চোরেদের চুরির কৌশল আর বুদ্ধির জোরে।
এই এলাকায় আর আশেপাশের বড়ো এলাকার চোরেদের গ্যাং-মাস্টার নাকি নির্বাচিত হয়েছে কুখ্যাত ছিনতাইকারী শাম্মি সিং ওরফে শেল্টো মস্তান। চোরেরা যাকে গুরু বলেই সম্বোধন করে। এটাই নাকি গ্যাংয়ের রীতি। এখানকার রীতি অনুযায়ী চুরি করা সমস্ত জিনিসপত্র নিলাম হয়। তারপর জিনিসপত্রের নিলাম মূল্যবাবদ প্রাপ্য অর্থ ভাগাভাগি হয়ে সব চোরেদের হাতে এসে পৌঁছোয়।
খড়িবাড়ির এক স্কুলের সহকারি শিক্ষক মনোতোষ সাহা টিফিন করতে রামদাস বাইনের রেস্টুরেন্টে আসেন। সেখানে এসে দেখেন অভিজিৎবাবু আর দ্বিজেনবাবু রংবাহারি টেবিলে বসে একমনে সাম্বার আর নারকেলের চাটনিতে চুবিয়ে ইডলি মুখে তুলছেন। পাশে কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্র এবং একটি ফিল্মি ম্যাগাজিন অগোছালো ভাবে রাখা।
মনোতোষবাবু বলে ওঠেন— আরে অভিজিৎবাবু যে! কী খবর?
—এই তো। বলুন কেমন আছেন?
—ভালো ভালো। কিন্তু চুরির ঘটনা চারদিকে যেভাবে থাবা বসাচ্ছে আর ভালো লাগছে না! খুবই দুঃশ্চিন্তায় আছি।
—শুনলাম পুলিশের লোক নাকি সিভিল ড্রেসে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোরেদের গোপন ডেরা আর ওদের খোঁজ পেতে পুলিশ নাকি একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
দ্বিজেনবাবু বললেন— রাতে কয়েকটি দল সব দিকে পাহারাদারিও করছে। যাক গে ভালোই! কী বলেন?
দ্বিজেনবাবু শিলিগুড়ির এক রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক-এ কর্মরত অফিসার। প্রতি রাতে মনোতোষবাবু আর ওনাদের বন্ধুবান্ধবরা তাদের অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ থেকে ফিরে, একটু কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়েন নিজেদের গল্প, কবিতা, অণুগল্প পাঠচক্রের আসরে। এই তো সেদিন ওই আসরেই আলোচনার মধ্যে উঠে এল চোরের উৎপাতের বিভিন্ন ঘটনা।
সেই আসরে অভিজিৎবাবু জানালেন— শুনেছ নাকি ভায়া, পনেরো-ষোলো দিন আগের কথা? নিতিন চাকলাদার, একটি পত্রিকার সিনিয়র এডিটর। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজ্যের বাইরে এক বড়ো হাসপাতালে তার চেকআপ করাতে। চারতলা বাড়ি ছিল ফাঁকা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চোর ওনার বাড়ির ভেতর ঢুকে দামি দামি সব জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়।
সকাল সকাল নিতিনবাবু ফিরে এসে প্রতিবেশীর মুখে সব কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন। ওনার স্ত্রীও কাঁদতে আরম্ভ করে দেন চিৎকার করে। একটু পরে লোকজন দেখে ঘরের চারটি তালাই অ্যাসিড দিয়ে নষ্ট করা। মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন, গ্যারেজে রাখা ফোর হুইলার কারের ইঞ্জিন, কম্পিউটার সব উধাও।
বিপ্লব রায় বলেন— আরে মশাই চোরের আতঙ্কে এখন রাতে বাইরে বেরুতেই ভয় হয়। মনে হয় এই বুঝি পেছন থেকে এসে ব্লেড বা ছুরি চালিয়ে দিল।
ভূপেন বোস যোগ দিলেন— আচ্ছা তোমাদের মনে আছে সেবার বিশ্বকর্মা পুজোর রাতে পালপাড়ার রবীন ভট্টাচার্য, তার শোরুমের লকার ভেঙে বহু মূল্যবান সোনা ও হিরের গহনা চুরি করে চোরেরা গা ঢাকা দেয় ?
দ্বিজেনবাবু বলে ওঠেন— হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আবার থাকবে না! সেই খবর পরের দিন দৈনিক সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল। নিউজ চ্যানেলগুলিতেও দেখিয়েছিল। আলোচনা শেষে সকলে মিলে চা, ডিম টোস্ট খেয়ে, সিগারেট টানতে টানতে, মুখে জরদা খয়ের দেওয়া পান চিবোতে চিবোতে বাড়ি ফেরেন।
পরের দিন এখানকার এক কলেজ প্রফেসার রাজীব সেন কলেজ সেমিনারে অংশগ্রহণ আর সেইসঙ্গে সমুদ্র সৈকতে মধুচন্দ্রিমায় যাবেন বলে নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মুম্বাইয়ের উদ্দেশে। পাশের বাড়ির পার্থ ব্যানার্জীকে বলে যান— পার্থদা একটু লক্ষ রাখবেন বাড়ির দিকটা। একরাশ দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ইষ্টদেবকে স্মরণ করে রামকৃষ্ণকে প্রণাম করে, বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট ধরে স্ত্রীকে নিয়ে রাজীববাবু বেরিয়ে পড়েন মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে।
যাবার ঠিক দুদিন পর এক চোর দেয়াল টপকে প্রবেশ করে রাজীবাবুর বাড়িতে। প্রথমে পাইপলাইন বেয়ে তিন তলায় ওঠে চোর। গেটের লক ভেঙে প্রবেশ করে তিন তলার বেডরুমে। চুরি করা সামগ্রী গুছিয়ে রাখতে অনেকটা সময় লেগে যায় চোরের। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটা আওয়াজ হয় পাশের রুমে, চমকে ওঠে চোর। পিছন ফিরে দেখে কালো মুখোশ পরা বিভৎস আকৃতির কে একজন দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। চোর তাকে জিজ্ঞাসা করে— – তুই ক্যাডারে ব্যাটা? এত রাতে এখানে কী করতাছিস?
ওই ব্যক্তির তখন পালটা প্রশ্ন— আগে তুই ক তুই কে?
—আমি চোর। আর তুই?
—দেইখ্যা কী মনে হচ্ছে? ওই চোর!
দ্বিতীয় চোর— ঠিক, আমি চোর। কিন্তু তোর গ্যাঙের না।
চুরির জিনিস নিয়ে দুজনের মধ্যে বহুক্ষণ বচসা হয়। মারপিটও হয় কে কোন জিনিস নেবে এই প্রশ্নে। শেষে সমঝোতায় আসে তারা- সোনা-গয়না, টাকা-পয়সা সব ভাগ করে নেয় তাড়াতাড়ি। এরপর অন্য জিনিসপত্রের দিকে হাত বাড়ায়।
(ক্রমশ…)