একদিন প্রবচন চলাকালীন, অজান্তে করা পাপের পরিণাম কী হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করছিলেন শম্ভুনাথজি। তাঁর কথা শুনে একতা চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওর খালি মনে হতে থাকে ওর শিশুর মৃত্যুর জন্য অজান্তে করা তার নিজেরই কোনও পাপ-ই নিশ্চিত ভাবে দায়ী। শম্ভুনাথের প্রতিটা কথার জাদু একতাকে একরকম বশ করে নেয় এবং বাবাজির দেখানো রাস্তায় চলাটাই একতার কাছে সঠিক বলে মনে হতে থাকে।

আজ হঠাৎ-ই, সৎসঙ্গ প্রসঙ্গে প্রতীকের এই প্রশ্নটা একতার কাছে কুরুচিকর বলে মনে হল। ওর মনে হল যে, প্রতীক সবসময় ওর সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে এসেছে। আজ তাহলে প্রতীক ওকে নিয়ে যেতে চাইল না কেন? এই প্রথমবার সৎসঙ্গ যাওয়ার ব্যাপারে একতা দ্বিধান্বিত বোধ করল। সন্ধে অবধি প্রতীকের না-ফেরা পর্যন্ত একটা অস্থিরতার মধ্যে একতার সময় কাটতে লাগল। রাতের খাবার খেয়ে দুজনেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে নিজের নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইল। হঠাৎ-ই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রতীক বলে উঠল, ‘আলমারিতে অনেক পুরোনো কাপড়-জামা জমেছে, সেগুলো কাজের মাসিকে দিয়ে দেব ভাবছি।”

—হ্যাঁ, অনেক নতুন জামাকাপড় কেনা হয়ে গিয়েছে, পরার তো জায়গাই পাই না। নতুন নতুন তাও পরা হয়, পরে পড়েই থাকে। কালই দিয়ে দেব। আচ্ছা শোনো কথায় কথায় মনে পড়ল, কাল আমাকে একটু টাকা দিও। আমাদের সৎসঙ্গ ভবনে গ্রুপ থেকে কিছু অর্থ সাহায্য দেওয়া হবে। শম্ভুনাথজি বলেছিলেন, দান করলে শুধু এই জীবনেই নয়, পরের জন্মেও কষ্ট আশেপাশে ঘেঁষতে পারবে না।

—একতা, তুমি নিজের জন্য খরচ করো আমার কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি তো ছাড়ো বরং আমি চাই তুমি আনন্দ, ফুর্তি করো, খুশিতে থাকো। কিন্তু এই বাবাজির চক্করে টাকা বরবাদ করাটা আমার একেবারেই ঠিক বলে মনে হচ্ছে না।

গ্রুপে বন্ধুদের তাহলে আমি কী বলব? উদাস হয়ে একতা জিজ্ঞেস করল।

—আমার মনে হয় ওদেরকেও তোমার সঠিক পথ দেখানো উচিত।

প্রতীকের কথা শুনে একতা নিরুত্তর থাকাই শ্রেয় মনে করল।

একতার গ্রুপের সদস্যরা শম্ভুনাথজিকে টাকাপয়সা দেওয়া ছাড়াও ফল-মিষ্টি ইত্যাদি অনেক কিছুই পাঠায়। একতাই শুধু চুপচাপ দেখত, কারণ হাজার বলা সত্ত্বেও প্রতীক কিছুতেই দান করার জন্য একতার হাতে টাকা দিত না। একতাও প্রতীকের ব্যবহারের কোনও অর্থ খুঁজে পেত না। অথচ প্রতীক বাড়ির পরিচারিকাকে জামাকাপড়, খাবার, কম্বল কিনে দিয়ে যেমন সাহায্য করত তেমনি ড্রাইভারের একমাত্র সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগাতেও কোনওরকম কার্পণ্য দেখাত না। কিন্তু দান, পুণ্যার্জন, এসবের উপর প্রতীক একেবারেই বিশ্বাস রাখত না।

এদিকে শম্ভুনাথজি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়ে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে দান করার জন্য গ্রুপে মেসেজ পাঠাতে থাকতেন। প্রত্যেকটি মেসেজেই দান করার কী মাহাত্ম্য, সবিস্তারে লেখা থাকত। সুখ, শান্তি, পাপ থেকে মুক্তির জন্য দান-দক্ষিণা দেওয়াটা যে কতটা জরুরি সেটা পরিষ্কার ভাবে মেসেজে বোঝানো থাকত।

গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে একটা যেন প্রতিযোগিতার মনোভাব কাজ করত—। কে কতটা বেশি বাবাজিকে দান করতে পারে, যাতে নিজের সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবারের সদস্যদের উপর বাবাজির আশীর্বাদ, বর্ষিত হতে পারে। একতাও চেষ্টা করত নানা ছুতোয় প্রতীকের থেকে টাকা নিয়ে সেটা বাবাজিকে দিতে। এটা একতার কাছে দোষের মনে হতো না কারণ ওর মনে এটাই ছিল যে এতে কোনও বিপদআপদ প্রতীককেও ছুঁতে পারবে না। সৎসঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় একতা মাঝেমধ্যে ভীত হয়ে উঠত এই ভেবে যে, ভাগ্যের চাকা যদি ব্যক্তিকে খারাপ দিন এনে দেয় তাহলে তাকে কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়। মনে মনে একতা শম্ভুনাথজির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বান্ধবীদের ধন্যবাদ জানাত। ওর মনে হতো নয়তো এতদিনে ওকে নরকবাস ছিল অবধারিত।

একদিন অফিস থেকে ফিরতেই প্রতীকের মুখ দেখেই একতা বুঝল কিছু ভালো খবর আছে। জানতে পারল প্রতীকের প্রমোশন হয়েছে। চা-জলখাবার খেয়ে প্রতীক একতাকে তৈরি হয়ে নিতে বলল, রাত্রে বাইরে ডিনারে নিয়ে যাবে বলে।

রেস্তোরাঁর ডিম লাইটে বসে খাবার খেতে খেতে দুজনে ভবিষ্যতের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে রইল। প্রতীক জানাল ও নিজেদের বড়ো একটা ফ্ল্যাট কেনার মনস্থির করে ফেলেছে। খুশিতে একতার সুন্দর মুখ আরও ঝলমলিয়ে উঠল।

প্রতীক খাবার শেষে মিষ্টি অর্ডার করবে বলে মেনু কার্ড দেখতে লাগল। একতাও মোবাইলে নতুন মেসেজগুলো পড়তে লাগল। শম্ভুনাথজিরও মেসেজ ছিল একটা। তাঁর মেসেজের বিষয়টি ছিল যে, কোনও কিছু ভালো হতে যাচ্ছে তার উপর লোকেদের কুনজর পড়ে এবং এর ফলে প্রায় হয়ে যাওয়া কাজও বরবাদ হতে দেরি লাগে না।

এটা কাটানোর উপায় অর্থ বা জিনিসের মাধ্যমে কুনজর কাটিয়ে সেটা দান করে দেওয়া। এতে অশুভ দোষ ওই জিনিসের সঙ্গে দান হিসেবে চলে যায়। গ্রুপের অনেকেই নিজেদের অভিজ্ঞতাও ওখানে শেয়ার করেছেন— কীভাবে তাদের জীবনেও কিছু ভালো ঘটার প্রাকমুহূর্তে, হঠাৎই তাদের অপ্রিয় ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফোনের মেসেজ দেখতে দেখতে চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল একতা। হঠাৎ খেয়াল করল প্রতীক ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...