—ওখানে যাওয়ার কিছুদিন আগেই শোভনের স্কুলের ফিজ আর ওর বইখাতা কেনার জন্য দিদি আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। ওখানে গিয়ে দেখি শোভন একটা দামি মোবাইল কিনেছে। আমি অসন্তোষ প্রকাশ করলে দিদি বলে যে, ও একটা গানের প্রতিযোগিতায় মোবাইলটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। সোমনাথদাও নতুন গাড়ি কিনেছে। যেখানে ছেলের ফিজ দেওয়ার ক্ষমতা নেই সেখানে গাড়ি কেনার কীসের দরকার? খুব রাগ হয়েছিল দেখে। বুঝে গিয়েছিলাম আয়েশের জীবন কাটাতে ওরা দুজন আমাদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করছে। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আর কেউ আমাকে বোকা বানাতে পারবে না।
—আগে একথা তুমি বলোনি কেন?
—আমি সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।
—মানে…?
—একতা কিছুদিন ধরে আমি লক্ষ করছি তুমি সৎসঙ্গে যাতায়াত আরম্ভ করেছ। আমি জানি ওইসব জায়গায় ধর্মকর্মের নামে মানুষকে নানা ভাবে ভয় পাওয়ানো হয়ে থাকে। মাঝেমধ্যেই দানের মাহাত্ম্য শুনিয়ে টাকা-পয়সা হাতানোর ফন্দি করা হয়। কষ্টের উপার্জিত অর্থ কি এরকম অপদার্থ ব্যক্তির পেছনে ওড়ানোটা ঠিক? সেটা নিজের বোনই হোক কিংবা কোনও সাধু মহারাজ?
প্রতীকের কথা শুনে লজ্জিত হয়ে অপরাধীর মতো একতা নিজের সাফাই দিতে গিয়ে বলল, “আমি দানের কথা এজন্য বলতাম কারণ আমি শুনেছিলাম এতে সংসারের ভালো হয়।”
—কীরকম ভালো? তোমার মনের মধ্যে আগে ভয় ঢুকিয়ে তারপর সেই ভয় মন থেকে দূর করার প্রচেষ্টাকেই তুমি ভালো বলছ?
একতা মন দিয়ে প্রতীকের কথাগুলো শুনছিল।
—সোনা-রুপো দান করলে পাপ মুছে যায়, টাকা-পয়সা বা অন্যান্য সামগ্রী দান করলে স্বর্গে যাওয়া যায়, গ্রহণ লাগলে দান করো যাতে ওর খারাপ প্রভাব থেকে নিজেকে বাঁচানো যায়, পরিবারে কারও জন্ম হলে তার ভবিষ্যৎ সুখের জন্য, আর মৃত্যু হলে পরের জন্মে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য দান করা উচিত— এসবই তো সৎসঙ্গে বলা হয়ে থাকে তাই না একতা? প্রতীক জিজ্ঞেস করলে একতা মাথা নেড়ে সায় দেয়।
—তুমি কি কাউকে দেখেছ, যে স্বর্গ দেখেছে? তোমার কি মনে হয় না, স্বর্গ-নরকের কথা মানুষকে ভয় পাওয়াবার জন্যই বলা হয়ে থাকে। পরের জন্মের চিন্তা করে সুখ পাওয়ার ইচ্ছেতে এই জন্মের কষ্টের উপার্জন বিলিয়ে দেওয়া আদৌ কি বুদ্ধিমানের কাজ? এইসব নানারকম ভয় দেখিয়ে মানুষের কাছে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ আজকাল বেশিরভাগ সৎসঙ্গগুলোর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই একতা, যদি দান করলে পাপ দূর হয়ে যেত, তাহলে এর মানে কি দাঁড়াল বুঝতে পারছ? এর মানে এটাই যে— যত খুশি খারাপ কাজ করতে থাকো আর পাপ থেকে বাঁচতে দান করে যাও। এটা কি তোমার ঠিক বলে মনে হয়? প্রতীক একতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।
—না, এই রাস্তা তো মানুষকে ভুল দিশায় নিয়ে যাবে। একতার কাছে সবকিছু ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল।
প্রতীক একতাকে আরও পরিষ্কার করে বোঝানোর জন্য বলতে লাগল, ‘যারা রোদ্দুর, ঠান্ডা উপেক্ষা করে রাস্তায় জিনিস বিক্রি করে, তাদের সঙ্গে আমরা অল্প টাকা নিয়েও দরদাম করি। গরিব রিকশাওয়ালার সঙ্গে টাকা নিয়ে ঝগড়া করি অথচ দানপূণ্যর ব্যাপারে কোনওরকম চিন্তা না করেই গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা বরবাদ করে দিই।”
রেস্তোরাঁতে শম্ভুনাথের চেহারা দেখে একতার মনের মধ্যে ঘৃণা তৈরি হয়েছিল। প্রতীকের কথা বুঝতে পেরে একতা বলে উঠল, “বিলাসিতায় জীবন কাটাবার জন্য অন্যকে বোকা বানাতে ফাঁদ পাতে কিছু মানুষ। সক্ষম ব্যক্তি যদি পরিশ্রম না করে দান চায় তাহলে সেটা দেওয়া অন্যায়। এতে আমাদের জীবন নয় বরং দান যে নিচ্ছে তার জীবনই সুখের হবে। দান করতে হলে অনাথ আশ্রমে, গরিব শিশুদের কিংবা শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী মানুষকে দান করা উচিত। আর এবার থেকে আমি এটাই করব।’
প্রতীক হেসে ফেলল, “বাঃ তুমি তো খুব শিগগিরই ধরে ফেললে আমি কী বলতে চাইছি। আর তুমি যেটা বললে ঠিক সেই কারণেই দিদিদেরও আমি আর টাকা পাঠাব না। ওরা যখন কষ্টে ছিল আমি সবরকম ভাবে সাহায্য করেছি কিন্তু এখন ওরা আয়েশ করবে বলে টাকা চাইছে। ধর্মের নামে ভয় দেখিয়ে যেমন টাকা চাওয়া হয়, ঠিক তেমনি দিদিরাও আমাকে বোকা বানাচ্ছে। আমি সাহায্যের নামে অকর্মণ্য ব্যক্তিকে কখনওই মাথায় চড়াব না।”
—ভাবছি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপের সৎসঙ্গের সব সদস্যদের বাবাজির আসল চেহারার ছবি তুলে পাঠিয়ে দিই। দেরি হলেও আমি সবকিছু আজ বুঝতে পেরেছি! প্রতীকের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে একতা তার মোবাইল ফোনে, শম্ভুনাথজির একখানা ছবি তুলে ফেলল। বাবাজির বান্ধবি তখন তাঁর বাহুলগ্না।