শৈশবে আমরা প্রায় সকলেই তৃষ্ণার্ত কাক এবং জলের পাত্রের কাহিনি শুনেছি। সেই জলের পাত্রের নীচে কিছুটা জল দেখে কীভাবে তেষ্টায় কাতর কাকটি ছোটো ছোটো পাথর জলের পাত্রের মধ্যে ফেলে, জল পাত্রের উপর দিকে নিয়ে এসে তৃষ্ণা নিবারণ করেছিল। সঞ্চয় করার ব্যাপারটাও অনেকটা এরকমই। এটা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু একবার সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝে গেলে, সঠিক দিশায় পা রেখে কাজটি অনেক সহজে করে তোলা সম্ভব হয়। ছোটো ছোটো পদক্ষেপ নিয়েই ভবিষ্যতে বড়ো কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা বাড়ে।
শৈশবেই যদি সন্তানকে সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে যে-কোনও কঠিন সমস্যার সহজেই সে মোকাবিলা করতে পারবে। যে-অভিভাবকেরা ছোটো থেকেই সন্তানকে সঞ্চয়ের অভ্যাস করান, তারা সন্তানের অজান্তেই তাদের ভবিষ্যৎও সুরক্ষিত করে তোলেন। সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝলে টাকার মূল্যও সে বুঝতে পারে এবং খরচ করার অভ্যাসেও তার আমূল পরিবর্তন আসে।
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া অতিমারি এটাই স্পষ্ট করে দিয়ে গেছে যে— — মোটা অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন যে-কোনও সময়েই পড়তে পারে। সুতরাং সঞ্চয়ের গুরুত্ব বাচ্চাকে শৈশব থকেই শেখানো জরুরি হয়ে পড়েছে। বিপদের মুখোমুখি পড়লে মানুষ সাহায্য চাইবারও সময় অনেক ক্ষেত্রে পায় না অথবা চাইবার কথা মনে পড়ে না। তাই নিজের কাছে সবসময় নগদ বেশ কিছু অর্থ থাকাটা আজকের সময়ে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সন্তানকে টাকার মূল্য বোঝান
মুদ্রাস্ফীতি যেখানে আজ সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে বাচ্চাকে টাকার মূল্য বোঝানো খুব দরকার। বাচ্চার জানা উচিত অর্থের জন্য তার অভিভাবকেরা কতটা পরিশ্রম করছেন। বাচ্চার একটা চাহিদা পূরণ করতে তার মা-বাবাকে কতটা সময় কাজ করতে হচ্ছে। শৈশবেই বোঝানো দরকার বেহিসেবি খরচ করার অভ্যাস যে-কাউকেও ঋণগ্রস্ত করে তুলতে পারে।
সব চাহিদা পূরণ করার নয়
সন্তান মা-বাবার একান্ত আদরের এবং সন্তানের সব ইচ্ছেই মা-বাবা পূরণ করতে চান। কিন্তু বাচ্চাকে ডিসিপ্লিন শেখাতে হলে, পরিশ্রম করে অর্থ রোজগারের বিষয়টি এবং সেই সঙ্গে টাকার মূল্য শেখাতে হলে, বাচ্চার সব চাহিদাই সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করবেন না। কারণ তাতে ভবিষ্যতে এই অভ্যাস বাচ্চাকে সমস্যার মুখে দাঁড় করাতে পারে।
বাচ্চা জেদি হয়ে ওঠে, শাসন মানতে চায় না, নিজের প্রয়োজনকে বশে রাখতে না পারার কারণে অপরাধমূলক কাজেও ফেঁসে যেতে পারে। তাই শৈশব থেকেই বাচ্চাকে প্রয়োজনীয় এবং বিলাসিতার মধ্যে পার্থক্য করা শেখানো দরকার। কী খাওয়া উচিত, কোনটা কেনাকাটা করা অর্থহীন, কোন খরচটা এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন হবে ইত্যাদি বোঝানো দরকার শৈশবেই। এই শিক্ষা একদিনে নয় বরং ধীরে ধীরে দেওয়াটাই শ্রেয় হবে।
টাকা জমাবার জন্য পিগি ব্যাংক দিন
বাড়িতে জন্মদিনে উৎসব অনুষ্ঠানে অতিথিরা নিমন্ত্রণ রক্ষা করার পর অনেক সময়েই বাড়ির বাচ্চাদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে যান। এছাড়ও দাদু, দিদা বা নিকট আত্মীয়স্বজনরা প্রায়শই বাড়ির বাচ্চাদের হাতে টাকা দিয়ে থাকেন। বাড়িতেও মা- বাবা হাতখরচা হিসেবে সামান্য অর্থ দিয়ে থাকেন। এই পুঁজি বাচ্চা তৎক্ষণাৎ খরচ করে ফেলে নাকি সঞ্চয় করে? সঞ্চয় করার অভ্যাস হলে জানবেন বাচ্চার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। কিন্তু যদি সব টাকা সে খরচ করে ফেলে তাহলে ভবিষ্যতে এই অভ্যাস তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
যদি বাচ্চাকে সঞ্চয় করাবার অভ্যাস করাতে চান তাহলে শৈশব থেকেই বাচ্চাকে টাকার সঠিক ব্যবহার শেখান। শেখান, কিছু টাকা খরচ করলেও বাকিটা যেন সে জমায়। সঞ্চয়ের প্রতি বাচ্চাকে আকর্ষিত করার জন্য তাকে সুন্দর আকষর্ণীয় পিগি ব্যাংক কিনে দিন। পিগি ব্যাংকে টাকা ফেললে সঞ্চয়ের অভ্যাস সহজেই বিকশিত হতে পারবে।
সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দিন
সঞ্চয় করার অভ্যাস কী কী সুবিধা দিতে পারে বাচ্চাকে, তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলুন। এক মাসের জমানো অর্থে বাচ্চা কীভাবে বিনিয়োগ করতে পারবে সেটাও তাকে বোঝাতে হবে। বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ব্যাংকে একটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দিন। আজকাল ব্যাংকে বাচ্চার নামেই ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা রয়েছে। অ্যাকাউন্টে কীভাবে টাকা জমা করতে হবে শিখিয়ে দিন। এই ভাবেই ছোটো ছোটো সঞ্চয়ের অভ্যাস থেকেই ভবিষ্যতে কোনও বড়ো প্রয়োজন সহজেই মেটাবার তার সামর্থ্য হবে।
জিনিসপত্র নষ্ট করার অভ্যাস বন্ধ করান
অনেক বাচ্চাই পেনসিল, কাগজ, রাবার বা অন্য কোনও জিনিস নষ্ট করে। পেনসিল একটু ছোটো হলেই ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। কাগজে ২-৩ লাইন লিখে বাকি ফাঁকা রেখে পরের পৃষ্ঠায় আবার লেখা শুরু করে। বাচ্চাকে বোঝাবার চেষ্টা করুন গাছ কেটে পাতা বা কাগজ তৈরি হয়। সুতরাং খাতার পাতা নষ্ট করা মানে নতুন একটি গাছ কাটার প্রস্তুতি নেওয়া। আমরা বাঁচার জন্য গাছ থেকে অক্সিজেন পাই তাই গাছের বেঁচে থাকাটা খুব দরকার। এই ভাবে গল্প করার মাধ্যমে বাচ্চার নষ্ট করার অভ্যাস বন্ধ করুন।
বেহিসেবি ফালতু খরচায় ক্ষতি
বাচ্চাদের বিস্কুট, চকোলেট, কোল্ড ড্রিংক, পিৎজা-বার্গার, মোমো ইত্যাদি ফাস্ট ফুড খাওয়ার জেদ পূরণ করতেই পরিবারে খরচের বাজেট ক্রস করে যায়। ফাস্ট ফুড স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে। বাচ্চার শরীরে মেদ জমতে আরম্ভ করে ফলে বাচ্চা অলস হয়ে পড়ে। বাচ্চা ভাবতে আরম্ভ করে তার যে-কোনও চাহিদাই মা-বাবা অনায়াসে মেটাতে সক্ষম। বাচ্চাকে বোঝানো দরকার সামান্যতম অর্থ সংগ্রহ করতে কতটা পরিশ্রম করার প্রয়োজন হয়।
বাচ্চাকে বোঝাতে হবে টাকা-পয়সা না থাকলে কত কাজ আটকে যেতে পারে। বাচ্চার স্কুলের মাইনে, বাড়িতে বয়স্ক ব্যক্তির ওষুধপত্র, পোষ্যের খাওয়াদাওয়া, জল, ইলেক্ট্রিসিটি, প্রসারি ইত্যাদি সবকিছুই তার মধ্যে পড়ে।
বাজেট নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাচ্চাদেরও শামিল করুন
সংসারে মাসিক বাজেট তৈরি করার সময় বাড়ির বাচ্চাদেরও শামিল করুন। আপনার চিন্তা, টাকা-পয়সার অসুবিধা, দেওয়া-নেওয়ার সঠিক পরিস্থিতি বুঝতে পারলে, দেখবেন বাচ্চা নিজে থেকেই বাজে খরচ করার অভ্যাস ছেড়ে দেবে। বাচ্চা নিজের পকেটমানি জমিয়ে বাড়ির খরচায় সাহায্য করতে আরম্ভ করাটা একটা ভালো লক্ষণ মনে রাখবেন।
বাচ্চার সঞ্চয় থেকেই ওকে উপহার দিন
বাচ্চার সঞ্চিত অর্থ থেকেই ওকে ওর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিন। হতে পারে অনেক দিন ধরেই পড়ার নতুন চেয়ার টেবিল, গল্পের বই, টেবিল ল্যাম্প বা ভিডিও গেম কিনে দেওয়ার বায়না করছে আপনার সন্তান। সুতরাং বাচ্চাকে জমানো অর্থ থেকেই তার চাহিদামতো জিনিস কিনে দিন। এতে বাচ্চা গর্বিত বোধ করবে এবং সঞ্চয় করার উৎসাহ বাড়বে। নিজের টাকায় কেনা জিনিসের যত্নও সে মন দিয়ে করবে।
বাচ্চাকে ক্রিয়েটিভ হতে শেখান
বাড়িতে পড়ে থাকা পুরোনো জিনিস থেকে কিছু না কিছু তৈরি করে বাচ্চাকে দেখান এবং তাকেও কিছু ইনোভেটিভ তৈরি করতে প্রেরণা দিন। কোল্ড ড্রিংকস-এর খালি শিশি দিয়ে পেন-পেনসিল স্ট্যান্ড, আইসক্রিম স্টিক দিয়ে ল্যাম্প বানানো বা ভাঙা খেলনা দিয়ে ক্রাফ্ট বানানোর মতো জিনিস তৈরি করতে বাচ্চা আনন্দ পাবে। বাচ্চাদের নিজেদের পুরোনো জিনিসই আবার করে ব্যবহার করতে শেখান।
পেনসিল, ইরেজার ইত্যাদি পুরো শেষ হয়ে গেলে, তবেই নতুন নিয়ে ব্যবহার করতে বলুন। বাচ্চাকে বোঝান কীভাবে অকেজো জিনিস দিয়েই নতুন এবং আকর্ষর্ণীয় জিনিস বানানো সম্ভব। এতে বাচ্চা সৃজনশীল তৈরি হবে এবং সেই সঙ্গে শৈশব থেকেই যে-কোনও জিনিসের কদর করতেও শিখবে।
পকেটমানি কমানো
প্রতি মাসে বাচ্চার হাত খরচের জন্য যে-টুকু অর্থ বরাদ্দ হয় তার থেকেও অর্থের পরিমাণ কমানো উচিত— যাতে বাচ্চা বেহিসেবি খরচা করতে অভ্যস্ত হয়ে না ওঠে। বাচ্চার খরচের হাত কমানোর চেষ্টা করুন। বাড়ির কোনও কাজ করে দিলে পুরস্কার হিসেবে কিছু অর্থ বাচ্চার হাতে তুলে দিতে পারেন। বাচ্চাকে নিজের ঘর পরিষ্কার করতে বলুন, তার বদলে অথবা ভাই-বোন কারও হোমওয়ার্ক করতে যদি সে সাহায্য করে— তাহলেও গিফ্ট হিসেবে বাচ্চাকে কিছু টাকা দিতে পারেন। এই প্রাপ্ত অর্থ বাচ্চা নিজের পিগি ব্যাংকে জমাতে পারে। কোনও কাজে কতটা অর্থ দেওয়া উচিত সেটা কাজটা কতটা কঠিন, তার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কাজের বিনিময়ে টাকা পেলে বাচ্চা কাজ করতে উৎসাহিত হবে এবং শ্রমের গুরুত্ব এবং টাকার মূল্য বুঝতে শিখবে।
অর্থ সাশ্রয় করলে পুরস্কারের ব্যবস্থা
বাচ্চাকে দেওয়া অর্থ থেকে সে যদি কিছু সাশ্রয় করে, তাহলে বাচ্চার মনোবল বাড়াতে অবশ্যই তাকে পুরষ্কৃত করুন। নতুন পোশাক কিনে দিতে পারেন বা বাচ্চার পছন্দমতন তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে কিছু খাওয়াতে পারেন। খেলার জন্য একটু বেশি সময় বরাদ্দ করতে পারেন। এছাড়াও পিগি ব্যাংকে জমানো টাকা বাচ্চার নামে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট-এও জমা করে দিতে পারেন।