কয়েকটা বিপণিতে হাঁটুর উপরে থুতনি রেখে বসে থাকা অপেক্ষমান সুন্দরীদের দেখে অনুভব করেছিলাম আগুনের আঁচ, যে আঁচে পতঙ্গের ডানা পুড়ে যায়। টনি জানাল, এরা সবাই রেড কারেনের উপগোষ্ঠী পাদাউং সম্প্রদায়ভুক্ত এবং সকলেই বর্তমানে থাইল্যান্ডের অভিবাসী। আশির দশকের শেষে এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, মায়ানমার অর্থাৎ বার্মার সামরিক শাসনকালে সরকারের সঙ্গে বিরোধের কারণে নির্যাতিত হয়ে এরা সীমান্ত অতিক্রম করে এই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রিত হয়। দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করার পরও এদের নাগরিকত্ব অনুমোদন করেনি থাই সরকার। এমনকী এই নির্দিষ্ট আস্তানার বাইরে গিয়ে মনের মতো কাজ খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা, থাই জনগণের মতো পানীয় জল, বিদ্যুৎ, আবাসন, স্বাস্থ্যপরিষেবা বা শিক্ষার সীমিত সুযোগ— প্ৰায় সবকিছু থেকেই বঞ্চিত।
ভাবতে অবাক লাগে, এই সম্প্রদায়ের মহিলাদের কম্পিউটার বা মোবাইল ব্যবহারের যেমন অনুমতি নেই, তেমনই বাইরের পর্যটকের কাছে নিজেদের সমস্যাজনিত কোনও আলোচনা করারও স্বাধীনতা নেই। দোভাষি টনির মুখে ওদের কাহিনি যতই শুনছি, মনের খিদে ততই বেড়ে যাচ্ছে। বড়ো ইচ্ছে করছিল মুখে পাউডার মাখা, চন্দনের উল্কি আঁকা সরল সাধাসিধে এই নারীদের সঙ্গে একান্তে সুখ-দুঃখের গল্প করি। ওদের মনের কোণে জমানো ব্যথা গলে পড়ুক মোম হয়ে! কিন্তু ওদের সবারই যে কথ্যভাষা বার্মিজ বা পাদাউং এবং এরা প্রায় কেউই ইংরেজি ভাষায় পটু নয়। বিশেষ করে প্রবীণ মহিলাদের কথ্যভাষা অতি দুর্বোধ্য। আমি ইশারার মাধ্যমেই অনুধাবন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে এটাই মঙ্গল যে, নতুন প্রজন্মের কিছু মেয়ের সামান্য থাইভাষা জ্ঞান রয়েছে। টনি তাদের কাছে গিয়ে বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিল আর পকেট বইয়ে লিপিবদ্ধ করছিল।
টনির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে শেষ প্রান্তের একটা বিপণিতে কিছু অসামান্য হস্তশিল্প পছন্দ হয়ে গেল। দরদাম করে আলাদা করে রেখে দিতে অনুরোধ করলাম হস্তশিল্পী চমদেন-কে। ওই বিপণিতে আরও দু’জন প্রবীণা মুখোমুখি বসেছিল। দু’জনেরই শীর্ণকায় ঘাড় ও গলা দেখে হঠাৎ মনে হল— ওদের শরীর থেকে মাথা সম্পূর্ণ আলাদা। তারা উভয়েই প্রায় পঁচিশটি করে ধাতব রিংয়ের কুণ্ডলী পরে আছেন যেটা প্রায় চিবুক পর্যন্ত প্যাঁচানো। জানতে পারলাম, একজনের নাম মিমা এবং অপর জনের নাম থুজার।
ওনারা ভাঙা ভাঙা থাই ভাষায় টনিকে জানাল, তাদের গর্বের সংস্কৃতি অনুযায়ী গলা লম্বা রাখার জন্য ওরা চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই সম্পূর্ণ নিজেদের ইচ্ছেতেই এই ধাতব রিং পরে আসছে। ওদের সম্প্রদায়ের রীতি- প্রত্যেক পরিবারে মেয়ে একটু বড়ো হলেই এই রিংগুলো তাদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়। ওরা বিশ্বাস করে, বংশপরম্পরায় মেয়েরা এই বলয় পরিধান করলে নাকি মন্দ আত্মা দূরে সরে যায়, পরিবারে সৌভাগ্য ফিরে আসে এবং শান্তি বজায় থাকে।
কথার মাঝেই উলটোদিকের দোকান থেকে নাম ধরে ডাকতেই একটি বছর পাঁচেকের ফুটফুটে মেয়ে ছুটে এল। ওর নাম এইন্দ্ৰা৷ অবাক হয়ে দেখলাম, ওই শিশুটির গলাতেও তিন লেয়ারের ধাতব রিং লাগানো। একরত্তি শিশুর কোমল গলায় এমন ধাতব বলয় দেখে খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল। ওর গলায় হাত দিয়ে দেখলাম রিংগুলো সহজে খোলার কোনও উপায় নেই। রিংগুলো গলার সঙ্গে চেপে বসে আছে।
মিমা ও থুজার জানাল— বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক বহন ক্ষমতা অনুযায়ী এই ধাতব রিংয়ের ওজন বেড়ে চলে এবং যা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত গলায় থাকে একই ভাবে। এই ধাতব রিং পরেই ওদের রাতে শুতে হয়। এরা চিরকাল তাদের পিঠের উপর ভর করেই চিৎ হয়ে শুতে বাধ্য হয়, যেটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। কোনওদিন পাশ ফিরে আরাম করে শুতে না পারায়, এদের ঘুমও ভালো করে হয় না। প্রায়ই শারীরিক দুর্বলতায় ভোগে।
স্বামীদের কাছে বেশি ভালোবাসা পেতে, কেউ পাঁচ কেজি ওজনের কেউ বা দশ কেজি ওজনের ধাতব রিং গলায় পরে নিজেদের গলাকে আরও লম্বা করতে আগ্রহী হয়। শুনলাম, যে নারীর যত লম্বা গলা থাকে এবং সেই গলায় যত ভারী এই অলঙ্কার থাকবে, সেই নারী কায়ান সমাজে তত বেশি সমাদৃত হয়ে থাকে।
উপস্থিত কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম— গলা বা ঘাড়ের অংশ লম্বা করা নিয়ে কায়ান সম্প্রদায়ের মহিলাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা রয়েছে। কারণ এইভাবে ধাতব রিং লাগানোর পদ্ধতিতে গলা বা ঘাড়ের অংশ কখনওই লম্বা হওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ভাবতে গেলে, এই ভারী বলয়ের বিশাল ওজনে মেয়েদের কলারবোন অর্থাৎ কণ্ঠা, নীচের দিকে চেপে বসে বুকের পাঁজরকে সংকুচিত করে তোলে এবং যার ফলে আমাদের দৃষ্টি বিভ্রম হয়ে ওদের ঘাড় বা গলা লম্বা দেখতে লাগে। ভর দুপুরে ঘুরতে ঘুরতে কায়ান নারীদের অস্থায়ী আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে এক চলমান ভ্যান থেকে আমি আর টনি কফি কিনে খাচ্ছি, এমন সময় পরিচয় হল স্থানীয় থাই সম্প্রদায়ের ষাটোর্ধ্ব থুয়ানথং নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। ইনি খুব ভালো ইংরেজি বলেন ও বোঝেন। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম, উনি এই কায়ান সম্প্রদায়ের নারীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। সুযোগ পেয়ে বহু অজানা কাহিনি জানলাম ওনার কাছ থেকে।
(ক্রমশ…)