হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস, স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ প্রাচীন মন্দির, অনন্য শিল্প ও সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এখানকার সহজ-সরল মিশুকে মানুষ এসবের টানে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ ট্যুরিস্ট এখানে বেড়াতে আসেন। আমার এবারের ইন্দোনেশিয়ার বালি ভ্রমণও কিছুটা সেই কারণেই।

সিডনি থেকে সকালে রওনা দিয়ে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বালির ডেনপাসার এয়ারপোর্ট। আগে থেকেই গাড়ি বুক করা ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে আসতেই চোখে পড়ল বছর তিরিশের একটি ছেলে আমাদের নাম লেখা একটা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে। বুঝতে অসুবিধে হল না ইনিই আমাদের ড্রাইভার, সালিহিন। ওর সঙ্গে ট্রাভেল প্ল্যান নিয়ে আগেই ফোনে কথা হয়েছে।

আমাদের হোটেল বুক করা আছে কুটা বিচের পাশে। ভেবেছিলাম আগে হোটেলে চেক ইন করে তারপর কুটা বিচের আশেপাশে একটু ঘুরে দেখব। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে সলিহিন বলল, ‘আপনারা যদি এখন হোটেলে যান তাহলে আজকের সারা দিনটাই মাটি হয়ে যাবে। এটা আপনাদের অস্ট্রেলিয়া নয়। এখানের ট্রাফিক জ্যামের কথা মাথায় রেখে ট্রাভেল প্ল্যান করতে হবে।’

প্রথমে একটু অবাক হলেও সন্নিহিনের কথার যথার্থতা বুঝতে বেশি সময় লাগল না। আমার পাঠানো লিস্ট দেখে ও বলল, “তার চেয়ে বরং এয়ারপোর্টের আশেপাশে বেশ কিছু সুন্দর জায়গা আছে, চলুন সেগুলো আগে আপনাদের দেখিয়ে দিই। তারপর রাতে আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দেব।’ ছেলেটা স্মার্ট, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না।

সলিহিন প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল ‘নুসা ডুয়া’ বিচ দেখাতে। বালিনিজ ভাষায় যার অর্থ ‘দুটো দ্বীপ”। গগার দ্বীপ আর পেনিনসুলা দ্বীপ এখানে একসঙ্গে মিলিত হয়েছে, তাই এই নাম। নুসা ডুয়াকে অনেকটা গেটেড কমিউনিটি বলা যেতে পারে। এখানকার হোটেল, রেস্তোরাঁ, কনফারেন্স হল, গল্ফ কোর্স সব কিছুই উচ্চবিত্ত এবং সেলিব্রিটি ট্যুরিস্টদের চাহিদা এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। ঝকঝকে সাদা সিঙ্কের মতো নরম বালির সৈকত, ফিরোজা রঙের জল, মৃদু ঢেউ, লম্বা পাম গাছ ঘেরা শান্ত পরিবেশ যে-কোনও পর্যটকের হৃদয় হরণ করতে বাধ্য। এখানকার আরেকটি আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হল নুসা ডুয়া ব্লো হোল। ভারত মহাসাগরের জলের ঢেউ এসে এখানকার পাথুরে পাহাড়ের উপর আছড়ে পড়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পাথরগুলোকে ক্ষয় করে ফেলেছে। জায়গায় জায়গায় ফাটল তৈরি করেছে। তাই জোরে ঢেউ এলে সমুদ্রের জল এই ফাটলের ভিতরে ঢুকে এক অপূর্ব সুন্দর জলের ফোয়ারা তৈরি করে। আর এই ফোয়ারার একটা পারফেক্ট ফটো তোলার জন্য পর্যটকরা এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে।

এরপর নুসা ডুয়া থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম পূজা মণ্ডলার দিকে। দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার কিন্তু যেতে সময় লাগল আধ ঘণ্টা। একেই বলে বালির ট্রাফিক। বালির ইতিহাস এখানকার শিল্প, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মতোই বৈচিত্র্যময়। বালির আদিম অধিবাসীরা অ্যানিমিজম অর্থাৎ প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাসী ছিল। তারপর বিভিন্ন বহিরাগত শক্তির প্রভাব পড়তে শুরু করে এই দ্বীপের উপর। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব দিয়েই বালির এই যাত্রাপথ শুরু হয় বলে জানা যায়।

ভারতীয় ব্যবসায়ী আর নাবিকরা ভারতীয় শিল্প, স্থাপত্য এবং সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিল এই দ্বীপে। সেই সময় বালিনিজ রাজপরিবার এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকেরা সানন্দে ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। নবম শতাব্দীর মধ্যে বালিতে একটি শক্তিশালী হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। এই সময় অসংখ্য মন্দির তৈরি করা হয়েছিল, যারা আজও স্বমহিমায় বিরাজমান।

পূজা মণ্ডলা বালিনিজদের ধর্মীয় বৈচিত্র্য আর সহিষ্ণুতার প্রতীক। সব ধর্মের মানুষ কীভাবে একসঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে, পূজা মণ্ডলা মন্দির তারই প্রতীক। আসলে পূজা মণ্ডলা কোনও বিশেষ ধর্মের মন্দির নয়। এখানে একই জায়গায় পাশাপাশি পাঁচটি মন্দির রয়েছে। জগন্নাথ মন্দির, বৌদ্ধ বিহার গুণ, ক্যাথলিক সান্টো থমাস চার্চ, প্রোটেস্ট্যান্ট ইমানুয়েল চার্চ এবং ইবন বতুতা গ্র্যান্ড মসজিদ— একই প্রাঙ্গণে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটালাম। ধর্মকে যেন এক অন্য রূপে দেখতে শেখাল এই পূজা মণ্ডলা কমপ্লেক্স। পারস্পরিক সহনশীলতা আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সত্যিকারের রূপ হয়তো এরকমই হয়। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এল। সলিহিনকে বললাম, ‘এবার হোটেলে নিয়ে চলো।’ সে-ও মাথা নেড়ে সায় দিল।

—কতক্ষণ লাগবে হোটেলে পৌঁছোতে?

—এখন বিকেলের ট্রাফিক। ঠিক বলতে পারছি না কতক্ষণ লাগবে। তারপর একটু হেসে বলল, এক্ষুনি তো ডাবের জল খেলেন, এবার নিশ্চিন্তে গাড়িতে বসে রেস্ট নিন। আমি ঠিকমতো হোটেলে পৌঁছে দেব।

সত্যিই তো৷ বালির ডাব, আমি এত বড়ো ডাব আগে কোথাও দেখিনি। সে যেন অমৃত! তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। এক ঘণ্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেলাম৷ হোটেলটা ঠিক কুটা বিচ-এর পাশেই। হোটেলের রুম থেকেই কুটা বিচ দেখা যাচ্ছে। হোটেলে চেক ইন করে আবার বেরিয়ে এলাম। সামনে কুটা বিচ যেন আমাকে দু’হাত তুলে ডাকছে।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...