শোভন তাঁকে আশ্বস্ত করে এই বলে— আমার অধিকাংশ লেখাই লিখতে বসার আগে থেকেই চিন্তায় থাকে। চিন্তার ভিতরে বিশ্লেষিত হতে হতে নিরাকার কল্পনা একসময় সাকারে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই রূপ বা কাহিনি ও বক্তব্যের সামগ্রিক চেহারা স্পষ্ট না হলে আমি লিখতে পারি না। এক কথায় এটাই আমার বিলাসিতা বলতে পারেন।

—সাধারণত কোন সময় লেখো?

—বাড়ির সবাই শুয়ে পড়লে, রাতেরবেলায় লুকিয়ে, শোভন নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে। আবার কেউ যখন বাড়ি থাকে না সেই সময়।

পিসেমশাই জিজ্ঞাসা করেন— লিখে তৃপ্তি পাও মনে?

—গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত তন্ময় হয়ে যাই যেন অর্জুনের লক্ষ্যভেদ। গল্প ছাড়া তখন কোনও কিছু ভাবতে ভালো লাগে না। কিন্তু গল্পটি লেখা যখন শেষ হয় তখন মনে হয় যেমনটি ভেবেছিলাম তেমনটি হল না। নির্ভেজাল তৃপ্তি পাই না। এ যেন মরুভূমির তপ্ত বালুর উপর দিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া মরুদ্যানের আশায়। যেমন একটা গানে আছে ‘মনেতে আঁকি তোমায় যেমন করে, তুলিতে হয় না আঁকা তেমন করে’।

পিসেমশাই এবার হেসে প্রশ্ন করেন— এই যে একটার পর একটা গল্প লিখেছ, ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক লিখবে। কিন্তু কেন লেখো? কার জন্যে লেখো? না লিখলেই বা কার কী আসে যায়?

—লিখি নিজেরই সমস্যা সমাধান করার জন্যে। না লেখা পর্যন্ত ভীষণ অস্বস্তি বোধ করি। মনে শান্তি পাই না। কাব্য করে বললে বলতে হয়, যেন ‘বৃথা জন্ম এ সংসারে’।

অন্যমনস্ক ভাবে খাতার পাতা উলটানোর অবসরে পিসেমশাই ‘অতসী একটি ফুলের নাম’ গল্পটি বের করে বলেন— তোমার লেখা এই গল্পটি পড়ে শোনাও তো একবার।

পিসেমশাইয়ের কথামতো শোভন উক্ত গল্পটি ছাড়া আরও একটি গল্প পাঠ করে। গল্প পড়ে শোনাতে মনে মনে খুব আনন্দ হচ্ছিল। অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সে আপ্লুত হয়ে উঠেছিল। একাকী নিজের গল্প পড়তে কারওরই ভালো লাগে না যতক্ষণ পর্যন্ত বারোয়ারি না হয়। কিন্তু সেদিন ভালো লাগছিল পড়ে শোনাতে। গল্প লেখার সার্থকতা যে কী তা সেইদিনই প্রথম অনুভব করেছিল। বিশেষ করে এক বয়স্ক লোকের মুখোমুখি বসে নিজের লেখা গল্প পাঠ করে শোনানোর মধ্যে যে-রোমাঞ্চ থাকে তা এরকম কোনও মুহূর্তের সাক্ষী যারা, তারাই হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন ভালো।

অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। অক্ষরগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। পিসেমশাই নিজেই এক সময় বললেন— -আজ এখানেই থাক। গল্পগুলো রেখে যাও। রাতে সময় পেলে পড়ব। তবে তুমি ভীষণ আবেগপ্রবণ। আবেগ সংযত করতে শেখো। এই রোগ অনেকটা জন্ডিস রোগের মতো! অতি কথনে গল্পের মান ক্ষুণ্ণ হয় সেইদিকে যেন সজাগ দৃষ্টি থাকে। পরিমিত শব্দ প্রয়োগের দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করবে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা আছে ‘সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’। সহজ কথায় লেখার অভ্যেস করতে হবে। ভূমিকা উপন্যাস লিখতে প্রয়োজন হয়, গল্পে বেমানান লাগে। তোমার এখনও কাঁচা বয়স। লিখতে থাকো একটু একটু করে দোষ কেটে যাবে। প্রথম বয়সের লেখায় ভুল-ত্রুটি থেকেই যায় তা নিয়ে হতোদ্যম হয়ে যেও না।

নিজগৃহে ফিরে আসার সময় শোভন পিসেমশাইয়ের কথাগুলো রোমন্থন করতে করতে একটু নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। তাঁর উপদেশগুলো যুক্তিসঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও কেন যেন মনে হচ্ছিল গল্পগুলো নিশ্চয়ই তাঁর ভালো লাগেনি। একবারের জন্যেও তিনি প্রশংসা করেননি। আশা করেছিল অন্তত একটু তারিফ করবেন বা সহানুভূতি দেখাবেন। কিন্তু না, তিনি আগাগোড়া কেবল ভালো না লাগারই আভাষ দিয়ে গেলেন। গল্পের বিষয়বস্তু চয়ন, উপস্থাপনা- – এসবের কিছুই তিনি উল্লেখ করলেন না। অতি সযত্নে তিনি এড়িয়ে গেলেন।

প্রায় মাস দেড়েক পরের ঘটনা। অম্লানের বাড়িতে শোভনের অবাধ যাতায়াত। একদিন ওর পড়ার টেবিলে পিসেমশাইয়ের সম্পাদিত ‘পঞ্চম’-এর সদ্য প্রকাশিত সংখ্যাটি হাতে নিয়ে বললে— এটা নতুন এসেছে বুঝি? তোর পড়া হয়ে গেছে?

আম্লান উত্তরে জানায়— আজকের বিকেলের ডাকে এসেছে এখনও খুলে দেখা হয়নি। তুই নিলে নিয়ে যা।

পত্রিকাটি শোভন বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তখনও সে জানত না যে, তার ভিতরে কী অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে। মলাটের পাতা উলটে সূচীপত্রের উপর চোখ বোলাতেই হঠাৎ তার দৃষ্টি থেমে যায়। কিছুতেই যেন চোখ দুটোকে সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। যেন প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেয়ে শোভন চারদিক অন্ধকার দেখতে থাকে। এ যে তারই রচিত গল্প ‘অতসী একটি ফুলের নাম’! তফাৎ শুধু এই যে, তার নামের বদলে লেখকের নাম উদ্ধৃত করা আছে যজ্ঞেশ্বর মৈত্র ওরফে পিসেমশাই।

অবদমিত কৌতূহলবশত প্রকাশিত গল্পটির সঙ্গে নিজের পাণ্ডুলিপিটি মিলিয়ে দেখার উদ্দেশ্যে সে যখন ফোল্ডার খোলে, তখন পাঁচটি স্বনির্বাচিত গল্পের মধ্যে ওই নির্দিষ্ট গল্পটিই নিরুদ্দেশ। শোভন ভগ্নহৃদয়ে পরের দিনই পত্রিকাটি ফেরত দিয়ে আসে। অথচ মুখ ফুটে সে একবারের জন্যেও বলতে পারেনি যে, তার গল্প চুরি হয়ে গিয়েছে। কি করে বলবে অম্লান যে তার একান্ত হিতৈষী, অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। এতদিনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বে যদি হঠাৎ ফাটল ধরে যায়!

কল্পনা করতে পারেন— প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উদ্‌গত অঙ্কুর শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে ওঠার আগেই যদি কেউ স্বেচ্ছায় মাড়িয়ে দেয়, তাহলে তাকে দেখতে কেমন লাগে?

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...