রাধামাধবের ইচ্ছেয় শেষ পর্যন্ত সে গোরাডাঙা পৌঁছে গেছে। কথা মতো বাস থেকে নেমে বোমেখাওয়া বাড়ি পেরিয়ে বাম পাশে শ্যাওলালাগা দু'খানি পুষ্করিণী ছেড়ে যে-রাস্তা কুবেরের মাঠে গিয়ে ঠেলে উঠেছে, সেই পথেই পা তার। সেই পথেই যে পড়বে অজয়কৃষ্ণ বৈরাগীর সাইকেল সারানোর দোকান।
একখান হলুদ রঙের সাইনবোর্ড আছে। তবে তা চোখে নাও পড়তে পারে। বনতুলসির ঝোপ এত সেয়ানা হয়েছে যে, লকলক করে সে সবকিছু আড়াল করে দিতে চায়। অজয়কৃষ্ণের মায়ার শরীর, সে যেমন তুলসিরে সরাতে পারে না, তেমনি কলমিলতাকেও চলে যেতে বলতে পারে না। সে যেমন গানই করুক, ভারি মোক্ষম তার শরীর। তার জন্যই তো দু-একজন বোষ্টম-বোষ্টমী আসে মাঝে মধ্যে। খানিক চাল-ডাল টাকা-পয়সার উপরি আয়। নাহলে তো সেই মধুকৃষ্ণা তিথির জন্য বছরভর অপেক্ষা করে থাকা। তখন ভক্ত বাউল-বৈষ্ণবের সমাগমে যা সেবাদ্রব্য জমা হয়, তাই সারাবছরের খোরাকি। এই অজ তেপান্তরের ভিতর কত লোক আর সাইকেল চড়ে! সাইকেল সারিয়ে অজয়কৃষ্ণের তেমন কিছু হয় না। কলমিলতাকে তাই মাঝে মাঝে অন্য গাঁয়ে যেতে হয় মাধুকরি করতে। এই গাঁ ফকিরদের গাঁ। এখানে বোষ্টমের মান নেই।
দুপুর থেকেই চৈতি অমাবস্যার দিন ভিড় জমতে থাকে ওই একচিলতে উঠোনে। মানে সাইকেলের দোকানের সামনে। রাত ভারী হতে গেলে তা সে ভিড় হাজার খানেক ছাড়িয়ে যাবে। সে ভিড় সামলাতে এপাশে ওপাশের বাড়িও হাত বাড়িয়ে দেয়। রাস্তা জুড়ে বৈষ্ণব, বৈষ্ণবীর ফিসফাস। বুনো তুলসি ঝোপের সে কী আনন্দ।
চৈত্র মাসের দুপুর পিছলে বিকেল পড়েছে। সে বাঁধনহারা পথ চলছিল তো চলছিলই। ননীগোপালের বুকে ভয়, যদি চোখের মাথা খেয়ে সাইকেল দোকান হারিয়ে ফেলে! কত কী যে চোখের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ননীগোপালের! সে ধরে রাখতে পারেনি। নিজের শিষ্য-শিষ্যা, আখড়া, গুরুকর্ম— কিছুই ধরে রাখতে পারেনি।
আর যার জন্য সব হাতছাড়া হয়েছে, সেই বাউলানিও টেকেনি। আজ যার খোঁজে পথে পথে ঘুরছে, একদিন সেই-ই তো ছিল তার সাধনসঙ্গিনী। চোখের পর থেকে সে যে কোথায় পলান দিল! মালাচন্দন করা ছিল। তাও! ওরকম সোনারবরণ! সবে ফুল ফুটেছে। প্রথমেই ভয় পেয়েছিল বলেই তো পাখিকে পিঞ্জরায় ঢোকাতে মালাচন্দন করা তড়িঘড়ি। তাও পাখি উড়ে গেল।