সৌম্য মুখের উপর এক ছড়া বিকেলের রোদফেলা হাসি মেখে জীবন গোঁসাই সেই সাপ আবার কাঁধের ঝোলার ভিতর পুরে দিয়ে বললেন, ‘বাবাজি, ভয়রে কাছাকাছি রাখতি হয়। সে কী করে দেখতি হয়। দূর থেকে ওই চোখের দেখা, মনের দেখায় বিস্তর ফাঁকি থাকি যায়। তাই তো যত হিংসে হিংসি। আমার ঝোলার ভিতর চালের ওমের ভিতর সে দিব্য এবার নিদ দেবেনে। তাইতো কতিছিলাম, ভয় পাতি হবে না।’

—যদি ঝোলার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে কামড়ায়!

আবার হাসেন জীবনকৃষ্ণ। ‘মানুষ ছাড়া অকারণে কামড়াবার মতো প্রাণী পাবা নানে।”

—তা আপনি একে নিয়েই বুঝি বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন?

—না না। তা কেন! আমি তো আর সাপুড়ে নই যে সাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াব। এই পথে আসতি আসতি তারে দ্যাখলাম। সেও ওদিকপানে যাতিছিল। তা আমি ভাবলাম, সে যাতিছে যখন সঙ্গে করে নিয়ে যাই। এরও ভালো, অন্যেরও ভালো। রাতের কালে আঁধারে সেখানে ভিড়ের ভিতর কে না জেনে গায়ে পা তুলে দেবেনে, আর এও ভয়ের চোটে ফোঁস করে গুঁতোবেনে। এর ভয় দূর করলি,অন্য মানষির ভয়ও যে দূর হয়। রাত শেষ হলি ওরে নদীর পাশে গিয়ে হলুদ বনের ভিতর ছাড়ি দেবানে।

ননীগোপালের চোখ স্বাভাবিক হয়ে এল বটে কিন্তু জীবন গোঁসাই-এর ঝোলা বাঁচিয়ে, ঝোলার উলটো দিক দিয়ে খানিকটা এগিয়ে হাঁটতে থাকে। হাওয়ায় চৈত্রের ধু ধু গন্ধ। রাস্তা সরেঙ্গা হয়ে কোনও মতলব ছাড়াই এগিয়ে গেছে। পথের সাথী যখন জুটে গেছে তখন আর পা চালাতে হিসেবনিকেশ আসে না। ধাক্কা খাওয়া ননীগোপাল কথা চালিয়ে স্বাভাবিক হতে গিয়ে বলে, “তা গোঁসাই, হাতের দোতারা পথ চলতি চলতি সচল হতি পারে না?”

জীবনকৃষ্ণ গোঁসাই মায়াবী একখান নজর মেলে বলেন, ‘কেন পারবে না বাবাজীবন। খুব পারবে। কতকাল ধরে এরা আমার দোসর হয়ে আছে। এরা কখনও বিশ্বেস ভাঙেনি বাবাজি।’

যেমন মায়াঝরা কথা বলা, তার থেকেও ঢের প্রাণ ভরানো মমতায় গোঁসাই জীবনকৃষ্ণ গান ধরেন। সঙ্গের দোতারা মানুষটিকে বুঝে সুরে আনচান হাওয়া দেয়—

‘সাঁই রাখলে আমায় কূপজল করে আন্দেলা পুকুরে। হবে সজল বরষা

রেখেছি এই ভরসা

আমার এই দশা

যাবে কত দিন পরে!”

ননীগোপাল গান শুনতে শুনতেই ঘোরের ভিতর ভাবে, এ গান তো ফেলনা নয়। এর মর্মরস আছে। ননীগোপাল একটু তন্ময় হয়। কিন্তু পা তার চলতে থাকে।

নদীয়ার সীমান্তে করিমপুরের কাছে গোরাডাঙা গ্রাম। এখানে ফকিরদের ঘাঁটি। তবে ওই এক-দু’ঘর বৈষ্ণব আছে। বৈষ্ণবরা ফকিরদের সাথে মিলমিশ করে থাকে। ওই অজয়কৃষ্ণ বৈরাগীর মতো আরও একজন আছে। তবে নাম ওই সাইকেল সারাই দোকানের মালিক অজয়কৃষ্ণের বেশি। তার ভিটেয় যে এই এতবড়ো একখান বাউল ফকির মেলা হয়। বারুণীর মোচ্ছব পড়ে। কত মানুষ যে আসে !

ননীগোপাল কথা চালনার কথা ফেলে। ‘আচ্ছা আপনি কন তো ওই সাইকেল সারানোর দোকানদার এত লোকের চাপ একা নেয় কী করে! খাতি, শুতি দেয় না? আমার যে খুব খিধে লাগতিছে।’

—হ্যাঁ হ্যাঁ, সে ব্যবস্থা আছে। একটা জগাখিচুড়ির ব্যবস্থা করে দেয় গ্রামের লোক মিলে।

—সেটা আবার কী?

—আরে জগাখিচুড়ি জানেন না বাবাজি! চাল-ডালের সাথে বিরাট বিরাট হাঁড়ির ভিতর গোটা গোটা সবজি ফেলে দেওয়া। কুমড়ো, ঝিঙে, আলু, পটল, লংকা— সব এক হাঁড়িতে। মানে গ্রামে ঘুরে এখানকার লোকজনেরা যাই ঘর থেকে বের করে দেয়, সবকিছুর মিল-মিশে ওই জগাখিচুড়ি। বেশ তৃপ্তি করে খাতি পাবেননে।

—তা অজয়কৃষ্ণ গোঁসাইয়ের নিজের কোনও গুরুপার্ট বা আখড়া নাই?

—না, সে থাকবে কী করে! এই গাঁয়ে তো বেশির ভাগই মোছলমান মানুষ। আখড়া চালাতে দেবে কেডা! মধুকৃষ্ণা তিথিতে ওই ‘অমাবস্যায় চাঁদের উদয় হয় বলে মোচ্ছবটাই শুধু সবাই মিলে গায়ে গতরে করে নেয় গ্রামবাসীরা। —ওহো, তাই বুঝি অজয়কৃষ্ণ বাবাজি সাইকেল সারাইয়ের দোকান দেছে!

—ঠিক ধরেছেন বাবাজি।

ননীগোপাল দেখে সেই সাপ থাকা ঝোলার ভিতর বাঁ হাত ঢুকিয়ে জীবন গোঁসাই কাগজে মোড়া কী যেন বস্তু বের করে আনে। ননীগোপালের খুব ভয় লাগে আবার যেন সাপের ফণা ধরে তার মুখের সামনে হাত তুলে না ধরে! জীবনকৃষ্ণ চলার ছন্দ বন্ধ না করে সরু সরু নারকেলের ছিবড়ে দিয়ে কলকের ভিতর ঠেসে দিতে দিতে বলল, ‘বাবাজির কি কিঞ্চিৎ গঞ্জিকা সেবনের অভ্যেস আছে?’

ননীগোপাল গাঁজা যে মোটেই খায়নি তা নয়। কিন্তু এই পথ চলতে চলতে গাঁজা খেলে সে কি সামলাতে পারবে! তাছাড়া সেবার এই গাঁজা খেতে গিয়েই তো বামুনডাঙার আখড়া থেকে তাকে হারিয়ে ফেলা! আট বছর কেটে গেল খোঁজা। আখড়ায় আখড়ায়, গুরুপার্টে গুরুপাটে, মোচ্ছবে মোচ্ছবে। তার দেখা নাই। এক নবীন চকচকে বোষ্টমের সঙ্গে সে সেদিন নদীর দিকে নেমে যাচ্ছিল। গাঁজার ধোঁয়ার অন্য পার দিয়ে চলে যাচ্ছিল। সেটুকু মনে আছে।

(ক্রমশ… )

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...