গান মাঝপথে থামিয়ে কথা চালানোর বাউল অভ্যাসে জীবনকৃষ্ণ বললেন, “বুঝলেন না বাবাজি, যে আগুনের জ্বালায় আপনি এই অজানা পথ পাড়ি দেছেন, আমিও চলতিছি। তেমনি করে আগুনের জ্বালায় সেথায় আরও বাউল-ফকিররা জড়ো হয়। এখানে তাঁর হেকমতিতে যে অনেক মানুষ নিজের অনেক না পাওয়া পেয়ে যায়।”
ননীগোপালের মেজাজ ফুরফুরে হয়েছে। খোলামেলা হয়েছে মন। সে বলল, ‘গোঁসাই, আমিও যে হারানিধির খোঁজে চলেছি সেখানে। শুনেছি ঘন কালো রাতে গৌরাঙ্গের খেলায় কত না বোষ্টম তার প্রাণের বোষ্টমীকে খুঁজে পায়। শুনেছি সেখানে এক ফানুস চলাচল করে। যে খোঁজে মনের মানুষ সেই শুধু ফানুস দেখতে পায়। ফানুস যে জায়গায় আকাশে দাঁড়ায়ে পড়ে, ঠিক সেখানেই মেলে তার পরম রতন।’ জীবনকৃষ্ণ হইহই করে ওঠেন।
—ঠিক শুনেছেন। তবে মনে হচ্ছে বাবাজির কোনও যাতনা আছে। যাতনা ধরে রাখতে নেই গো। তারে হাওয়ায় ভাসাতি হয়, নদীতে ভাসাতি হয়। বলতি হয়, যা যা দূর হ। নালে যে সারাজীবন বোঝা বইতে হয় গো। আরে দেখেন, আমি সেয়ানা পাগলের মতো কতিছি। আমিও তো বয়ে চলেছি। নাহলি সেথায় যাবই বা কেন! সেখানে যত বোষ্টম যায়, বাউল- ফকির যায় সক্কলেই তো বোঝা খালি করতে যায়। অমাবস্যায় চাঁদের উদয়।
ননীগোপাল এখানকার বারুণী উৎসবে আগে কখনও আসেনি। তার অল্প জানা। সে জানতে চায়। বলে, ‘বলেন তো গোঁসাই, আর এট্টুস বলেন। এখানকার মহিমা বলেন। অমাবস্যায় চাঁদের উদয় বলেন।”
—বাউল সাধনায় চাঁদ হল শুক্র। তার উদয়। সে তো যখন তখন যেখানে সেখানে উদয় হতি পারে। কিন্তু সাধকের কাছে যখন তখনের কোনও মূল্য নেই। গুরু ধরবার জন্য চাই যোগ। বাবাজি বাউলের কাছে বড়ো বস্তু হল গুরু। গুরু মানে নারী। —এ কী কচ্ছেন! এমন কথা তো আগে শুনি নাই।
—বাবাজি, দীনদয়ালের ঘরের করণকৌশল আর সহজিয়াদের থেকে খানিক আলাদা। সেখানে সব গুপ্ত সাধনা। মাটির কার্য, নালের কার্য, করোয়া সাধন— কত কী আছে!
ননীগোপাল এত কথার মানুষ নয়। কিন্তু তার ভিতরের আগল যেন খুলে গেছে এই সময়। সে বলল, “কিন্তু গোঁসাই আমরাও তো সহজিয়া। পাটুলি স্রোত।’
—শুনুন বাবাজি, এই জগতে সত্য হল নারীদেহ। নারীর কাছ থেকে সংকেত নিয়ে তবে সাঁতার দিয়ে রত্ন সন্ধানে যেতি হয়। তার দশমীদ্বারে লুকোয়ে থাকে মহারত্ন। পদ্ধতি জেনে তলাতল পাতাল থেকে সে মহারত্ন উদ্ধার করতি হয়। আমাদের সাহেবধনীদের গাথক কুবির গোঁসাইয়ের গান শোনেননি! ওই যে….
জীবনকৃষ্ণের গুবগুবি আর দোতারায় আবার সুর উঠল। জীবনকৃষ্ণ গান ধরলেন, ‘ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন।/ তলাতল পাতালে খুঁজলে পাবি রে প্রেমরত্নধন।’
ননীগোপাল ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘এই গান তো শুনেছি। কিন্তু তার যে এত তল জানতে পারিনি।”
—বাবাজি, সেই রত্নধন খুঁজতেই তো দীনদয়ালের খেলায় এত পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের এই মধুকৃষ্ণা তিথির পুণ্য ওঠাতে এখানে আসা। সব সময় মনে রাখবেন আলগা স্রোতে ডুবে মরলে মানুষ জীবন নষ্ট হয়ে গেল। ডুব মারতে হবে অতলে। আর সেই ডুব মারার মহাযোগ হল অমাবস্যা। নারীদেহের বাঁকে মাসে মাসে বন্যা আসে। আসে ঋতুকাল। এই বাঁকানদীর বন্যায় মহাযোগে ভেসে আসে মহামীন অধরমানুষ। তাকে ধরতে জানতে হয়। তার সঙ্গে মিলনে অটল হতে হয়। তবেই তো গুরুপ্রাপ্তি। আজ এই মধুকৃষ্ণা তিথিতে দলে দলে ঋতুময় বোষ্টমীরা আসবে। তাদের সাথে মিলিত হবে সাধক বাউল।
পথের ধুলোয় রং লেগেছে কিছুকাল হল। মানে সন্ধ্যা নামছে। দুই বাউল-বৈরাগীর পা উঠছে, পড়ছে। পথ ফুরোচ্ছে না। খালি মুখে পথ চলার বেজায় দায়। জীবনকৃষ্ণ দায়িত্ব নিয়ে পথের নির্জনতা নষ্ট করে চলেছেন। একসময় বললেন, ‘বাবাজির গোপন কথা তো শোনা হল না। যদি মন চায় বাবাজি, কতি পারেন। বাবাজির কি বাঁকা নদীর পিছল ঘাটে নাওয়া হয়েছিল?”
ননীগোপাল তখন এক অলীক ভাবনার ঘোরে। তার চোখ আকাশের দিকে। সেখানে সন্ধ্যাতারা সহ আরও দু’একটি মিটিমিটি ফুটে গেছে। তার লক্ষ্য তো তারা দেখা নয়। সে দেখতে চায় একটি ফানুস। সেই ফানুস যদি তার চোখে পড়ে আর সে সেই ফানুসের নীচে গিয়ে দাঁড়াতে পারে তবে তো কৰ্ম্ম ফতে। তার হারিয়ে যাওয়া পরমকে ফিরে পাবে আজ।
—বাবাজি, আজ মধুকৃষ্ণা তিথি। যাকে বলে বসন্ত মুচমুচে এই তিথি। চৈত্র মাসের কৃষ্ণা তিথি। মানুষের মনের ভিতর বসন্ত উপচে ওঠে গো৷ যতই কাছাকাছি পৌঁছোবে তিথি ততই আপনার ভিতরে দীনদয়ালের খেলায় প্রেম ডগমগ করে উঠবে। এট্টুস পথশ্রম হচ্ছে বটে তবে সব পুষিয়ে দেবেন দীনদয়াল।
(ক্রমশ…)