ননীগোপাল এসব শুনেই তো এসেছে। গত সাতবছর ধরে তো কম মেলা-মোচ্ছবে ঘোরা হল না তার! তাই সে আর বিশেষ কথা ফেলে না। মনের ভিতর যে একখান মিটিমিটি প্রদীপ জ্বালানো আছে, ননীগোপালের কাজ তাকে নিভতে না দেওয়া। আজ মন বলছে হবে। সেই চাঁপাকলির গন্ধ যেন ভেসে আসছে। ঝুমরার গায়ের গন্ধ।
নদী বা পুকুরে চানের সময় ঝুমরার কাপড়চোপড় নিয়ে সে ডাঙায় বসে থাকত। আর ঝুমরা নগ্নদেহে জলের গভীরে নেমে যেত। তার স্তনদুটি পদ্মফুলের মতো জলের উপরে ভাসত। সে সময় ননীগোপাল পাগলের মতো ঝুমরার কাপড় নিজের মুখের উপর ঠেসে ধরত। ওই কাপড়ে যে চাঁপাফুলের গন্ধ, তা দিয়েই নিজেকে আবিষ্ট রাখত। কামনা থামাত। গুরু শিখিয়েছিল প্রবৃত্তি দমন। শুক্র ধারণ। যতই কাম জাগুক, তাকে কবজা করতে না পারলে আর বোষ্টম থাকা যাবে না। ঝুমরার নগ্ন দেহলতা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেও ননীগোপাল কখনও জলে নামে না। ঝুমরা অনুযোগ করে, ‘ঢ্যামনা। অমানুষ একটা।’ কিন্তু গুরুর নির্দেশ কীভাবে অমান্য করবে ননীগোপাল!
—বুঝলেন বাবাজি, এই মেলা কেন আর আর মেলা থেকে আলাদা!
—কেন গোঁসাই?
এখানে সব বাউল, বৈষ্ণবই তার হারানিধি ফেরত পায়। কিন্তু সে ওই এক রাতের জন্য। তুলসির ঝোঁপের ভিতর আন্ধারে কেউ কারও মুখ দেখতি পায় না। কিন্তু যে যারে খোঁজে, তারে পেয়ে যায়। অঙ্গের বসন ফেলে বাউল-বাউলানি দেহ মন একাকার করে নেয় ওই এক রাতেই। সকাল হলেই কিন্তু আবার সবাই একা। ভোরের আগেই বাউলানি বা বোষ্টমী তার বাউলের আলিঙ্গন সরায়ে রেখে ভূমিশয্যা থেকে উঠে পিছনের নদীতে নেমে যায়। নদীর ওপারের ঘাটে ঠেলে উঠে তারা অন্য গাঁয়ের ভিতর দিয়ে হারিয়ে যায় আবার।
—আপনি গোঁসাই, আপনার বাউলানিরে যে পালেন তা জানলেন কেমনে। আন্ধারে তো কেউ কারে দেখতি পান না! -ওই ফানুস যে চিনোয়ে দেয়। বাউলানি ফানুস দেখে ফানুসের নীচে এসে দাঁড়ায়। আবার দীনদয়ালের কৃপায় সেই ফানুসই বাউলানিকে টেনে এনে বাউলের শরীরের কাছে ফেলে। এর অন্যথা নাই। সকলের আলাদা আলাদা ফানুস। দেখতি পালিই কৰ্ম্ম ফতে। আর কিচ্ছুটি করতি হয় না। সব আপনা আপনি হতি থাকে।
ননীগোপাল আকাশে চায়, ফানুস খোঁজে।
জীবনকৃষ্ণ আবার একটু বলেন, ‘বুঝলেন বাবাজি, আমার জন্যি দীনদয়ালের নজর যেন একটুখানি বেশি। ফানুসের টানে টানে আমি যেই আমার বোষ্টমীর কাছে যাই, আমি টের পাই আমার বোষ্টমীর গায়ের গন্ধ ভেসে আসছে। চাঁপাফুলের গন্ধ। তার শরীর তো শরীর নয়, যেন গুচ্ছ গুচ্ছ চাঁপাকলি। অন্ধকারে আমার চোখ ওই গন্ধের আবেশে বুজে আসে। আমি সম্বৎসরের মনের খোরাকি তুলে রাখি ওই গন্ধ দিয়ে।
ননীগোপাল পায়ের ছন্দে পথ চলছিল। সে তো পথ হাঁটছে না। কেউ তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনকৃষ্ণের কথার মানে বুঝতে খানিক সময় লাগে তার। এ কী কথা কলেন গোঁসাই। গোঁসাই কলেন, তাঁর বোষ্টমীর গায়ে চাঁপা ফুলের গন্ধ। কিন্তু তা কেন হবে! ননীগোপাল তো বছর পাঁচেকের আখড়া জীবন কাটিয়েছে। ঝুমরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাটিয়েছে। গুরুর আখড়ায় কত বোষ্টমী আসত কিন্তু কারওর গা থেকে চাঁপা ফুলের গন্ধ বের হতো না। তার ঝুমরা মাধুকরী করে ফেরামাত্রই ননীগোপাল টের পেত ঝুমরা ফিরেছে। তার নাকে চাঁপাফুলের তাজা ঘ্রাণ এসে যে ঘাই মারত।
রাত থমথম করছে। দু’পাশে জঙ্গল। জোনাকিও নেই। এই প্রথম ননীগোপাল চলা থামিয়ে দিয়ে পিছন ফিরে খোঁজ করে জীবনকৃষ্ণের। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। হাওয়াও নেই। ননীগোপাল বলে, “গোঁসাই আপনি কোথায়?’
কোনও উত্তর নেই। অন্ধকার প্রশ্ন গিলে খায়। ননীগোপাল আকাশে তাকায়। কোনও তারাও নেই। থাকবে কী, কৃষ্ণা তিথি যে। তাহলে উপায়! পা যেন ভারী গাছের গুঁড়ি হয়ে গেছে। নাড়ানো যাচ্ছে না। ননীগোপাল হাঁক পাড়ে, ‘গোঁসাই।” কোনও আওয়াজ বের হয় না। অজয়কৃষ্ণের সাইকেল সারাইয়ের দোকান এই অন্ধকারে কী করে সে খুঁজে পাবে! মনে পড়ল গোঁসাইয়ের কথা। ‘দীনদয়ালের খেলায় নিজে নিজে কিচ্ছুটি করতে হয় না বাবাজি। শুধু আকাশে চোখ রাখতি হয়। সেখানে উড়তে থাকা ফানুসই পথ চিনোয়ে নে যায়।
সারাদিন আজ ননীগোপালের কিচ্ছুটি পেটে পড়েনি। তেষ্টায় গলা গনগনে উনুন হয়ে আছে। কত পথ হেঁটেছে কে জানে! তার উপর গাঁজার তেষ্টাও যোগ হয়েছে। বুকের ভিতরে কে যেন কী যেন ঠেসে ধরেছে। ননীগোপাল এবার পরিত্রাহী একটা আওয়াজ করল, ‘ফানুস, তুমি কোথায়? আমারে নিয়ে চলো। আমি কিচ্ছুটি দেখতে পাচ্ছি না যে!”
(সমাপ্ত)