চঞ্চলা নদীর জলস্রোতকে লকগেটের শাসনে বেঁধে রেখে তৈরি হয়েছে জলঢাকা হাইড্রেল প্রজেক্ট। এখানেই তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুৎ। উত্তরবঙ্গের বিদ্যুতের চাহিদা অনেকটাই মেটে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। ৩৬.৯ মেগাওয়াট শক্তি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সেই বিদ্যুতের ভাগ পায় ভুটানও। কেন না, ভারত ও ভুটানের পারস্পরিক সহযোগিতায় তৈরি এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতের জলঢাকা এবং ভুটানের বিন্দু নদীর সংযোগস্থলে বাঁধটি। নদীর এপারে ভারত, ওপারে ভুটান। ইন্দো-ভুটান সীমান্তের এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে সাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সাকুল্যে চারটি গেট রয়েছে। অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে যাচ্ছে। জলকণায় সৃষ্টি হচ্ছে অনন্যমাত্রা। গুছিয়ে যে ছবি তুলব, ক্যামেরার লেন্সে ঝরে পড়ছে উড়ন্ত জলকণার ছিটে। সব কিছুই যেন বদলে যাচ্ছে, রোদ্দুরের রং, পাতার সবুজ।
দু’পা ফেললেই বিদেশের চৌকাঠ ছোঁয়া যায় এখানে। না, মানে বিদেশ কিন্তু সেভাবে বিদেশ নয়। নদীর প্রস্থ বরাবর একটু ওপরেই সেতুপথ। সফরনামা দেশান্তরী হয়, সেতু পেরিয়ে বিন্দুর ঠিক ওপারে ভুটান গ্রাম বকবাকি। তুখোড় অরণ্য, পাহাড় ও নদীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা আশ্চর্য নিরিবিলি এই গ্রাম। এখানে মূলত ভুটানি অধিবাসীদের বাস। তারা সযত্নে আগলে রেখেছেন তাঁদের সংস্কৃতি, লোকাচার, জীবনদর্শন।
সীমানায় দাঁড়ালেই গরম মোমোর গন্ধ উড়ে আসে এপারে। সেখানে এক ভুটানি জলপানের গুমটি থেকেই ভেসে আসছিল মোমোর সুবাস। ধূমায়িত স্যুপ সহযোগে খেলাম এক প্লেট ভেজ মোমো। পায়ের তলায় বিদেশের মাটি ছুঁয়ে ভুটানের তেভু অঞ্চল পর্যন্ত চলে যাওয়া যায় বহুবর্ণ সবুজের পর্দা সরিয়ে। কোনও ভুটানি বালক বা যুবা নিজেরাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে তেন্ডু গ্রামের আদ্যপ্রান্ত। নিজেরাই দেখিয়ে দেবে সেখানকার ভুটান সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ঘাঁটি। পর্যটন এইভাবেই চেনায় দেশ, সীমানা, সীমানার ওপার।
বতুল প্রস্তরখণ্ড নিয়ে নদীর বিস্তীর্ণ প্রবাহপথ জুড়ে বিন্দু লকগেটের নীচে নির্মিত হয়েছে জমা জলের চিত্তাকর্ষক ঠমক। বিন্দুতে মিলিত তিনটি নদী হল— বিন্দুখোলা, দুধপোখরি এবং জলঢাকা। সফেদ ফেনায়িত লাবণ্য সুষমাশোভিত সে জলের রং আকাশের ছায়া মেখে হয়ে উঠেছে আসমানি নীল। অপরূপ প্রকৃতিই এখানে স্বাগত জানাবে পর্যটককে। ইদানীং নদী পারাপার, ট্রেকিং, নদীর জলে মাছ ধরার মতো ক্রিয়াকলাপ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখানে। বহুল পরিচিত জায়গা ছেড়ে, ওরকম হাটখোলা নদীচত্বর আর প্রকৃতি পেলে আকাশ, মেঘ, পিচ গাছের ঝিরিঝিরি পাতা বিলি কাটবেই।
শহুরে বাস্তবের সাথে অপার ফারাকে হাতের কাছে স্বর্গ জুটে যাচ্ছে যেন। পাথর টপকে টপকে সাবধানে নেমে এলাম জলঢাকা নদীটির কোলে। শীতল বারির স্রোতে পা ডুবিয়ে বসি। এক নবীন উদারতায় পেলব শীতল আশ্রয়। অদ্ভুত মনকেমন করা জলধ্বনি ছড়িয়ে যাচ্ছে কর্ণকুহকে। সূর্যের আলো কমে এলে বিন্দুর চারপাশের প্রকৃতি হয়ে উঠল আরও মায়াবী। তবে বিনিসুতোয় বুনতে থাকা এই সম্মোহন ক্ষণিকের। খেয়াল করি অপরাহ্ণের আলোককণার সমস্তটাই তো শুষে নিচ্ছে ওই ঘাই মারা নদীজল।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া, শিয়ালদহ বা কোলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। স্টেশন চত্বর থেকে ভাড়াগাড়িতে জাতীয় সড়ক ১৭ ধরে বিন্দু ব্যারেজের দূরত্ব ১০৪.৯ কিলোমিটার। সময় লাগে কম বেশি তিন ঘণ্টার মতো। শিলিগুড়ি থেকে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের বাস, ভুটান সরকারি বাসেও যাওয়া চলে। মাল জংশন থেকে ৫৫ কিলোমিটার। লাটাগুড়ি থেকেও সড়কপথে ২০ কিলোমিটার দূরে চালসা পৌঁছে, গৈরিবাস হয়ে ঝালং, প্যারেন পেরিয়ে বিন্দু। ঝালং থেকে বিন্দু মাত্র ১২ কিলোমিটার। উড়ানপথে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে গাড়িতে বিন্দু।
কোথায় থাকবেন: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের (WBFDC) River Camp-এর তাঁবুতে থাকা এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। ঝালং বাজার ও প্যারেনেও নানা বাজেটে বেশ কিছু হোমস্টে হয়েছে এখন। এছাড়াও রয়েছে, জলঢাকা ফরেস্ট রেস্ট হাউস।
সেরা সময়: বছরের যে-কোনও সময়ই উত্তরবঙ্গের বিন্দু ঝালং যাওয়া যেতে পারে। তবে ভরা বর্ষা মরসুমে উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু পথ বিপদসংকুল হয়ে পড়ে। সেই মতো উচিত হবে আগাম খবরাখবর নিয়ে যাত্রা শুরু করা।