টিকটিক শব্দে ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘর ছুঁয়েছে। মাধবীলতা উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে পরাগ অধিকারীর জন্য অপেক্ষা করছেন। মাধবীলতা ছত্রিশ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। পূর্ণ যৌবনেই তার বুকের উপত্যকায় শূন্যতার গভীর গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে। বাইশ বছর কোনও পুরুষ সংসর্গ তো দূরের কথা, তিনি কোনও পুরুষকে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। লাইমলাইটের ঝলকানিতে আলোকিত সেলিব্রেটি ঔপন্যাসিক পরাগ অধিকারীর লেখার প্রতি আকর্ষিত হয়ে তিনি মানুষটার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেননি। এতগুলো বছর পর কোনও এক পুরুষমানুষের সঙ্গে আড্ডা দেবেন। মন খুলে কথা বলার জন্য কাউকে তিনি আজ সন্ধেয় পাশে পাবেন। অদূরে গাড়ির হর্ণে তিনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ব্যালকনি থেকে তিনি দেখলেন যে, পরাগ অধিকারীর গাড়ি তার বাড়ির সদর গেট দিয়ে ঢুকছে।
মাধবীলতা দোতলা থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে এলেন। পরাগ গাড়ি থেকে বেরিয়ে মাধবীলতাকে বললেন, ‘কেমন আছেন? জ্যামে পড়ে গিয়ে আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল৷’
—না, কিছু দেরি হয়নি। আবার আপনি! পরাগ, এটা কিন্তু খুব খারাপ হচ্ছে।
—ওহ, সরি। একদম খেয়াল ছিল না।
মাধবীলতা পরাগকে ডান হাত বাড়িয়ে বললেন, “এসো, উপরে এসো।’
মাধবীলতার পা অনুসরণ করে পরাগ উপরে উঠলেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পরাগ বললেন, “বাহ, খুব সুন্দর বাড়ি তোমার। রাজপ্রাসাদ একদম।’
মাধবীলতা বললেন, “আমার স্বামী নিজে পছন্দ করে দেখেশুনে এই বাড়ি বানিয়েছিলেন। নামকরা ইন্টেরিয়র ডেকরেটর দিয়ে ডেকরেশন করানো হয়েছিল। কিন্তু কী লাভ! উনি তো অকালেই চলে গেলেন।”
পরাগ কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে উপরে উঠলেন।
মাধবীলতা পরাগকে ডাইনিং রুমে বসতে দিলেন। মাধবীলতা পরাগকে বললেন, ‘তুমি একটু বোসো। আমি চট করে দু-কাপ কফি নিয়ে আসি। পরাগ বললেন, “আমার সুগার ছাড়া ব্ল্যাক কফি।’ মাধবীলতা স্মিত হেসে চলে গেলেন।
পরাগ ঘুরে ঘুরে ঘরের কারুকার্য, দেয়াল আলমারিতে দেশি-বিদেশি সাহিত্যের বিভিন্ন বই, শো কেসে অ্যান্টিক পিসের বিভিন্ন কালেকশন দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরই মাধবীলতা দু-কাপ কফি আর এক প্লেট কাটলেট, ফিশ কবিরাজি নিয়ে এলেন। । তিনি টেবিলে খাবারগুলো নামাতেই পরাগ একটু চমকে উঠে বললেন, “ওরে বাবা রে। এত খাবার কে খাবে! এত কী করেছ!”
—এটুকু খাবার খেতেই হবে পরাগ। তুমি আমার বাড়ি আজ প্রথম এলে।
—আমি এত খাবার খেতে পারব না। আমার অভ্যাস নেই।
—এটা কি ফিগার মেইনটেইন করতে! এগুলো কিন্তু একদম ঘরে বানানো। আমি নিজে তোমার জন্য বানিয়েছি। একটু অন্তত টেস্ট করে দ্যাখো।
—ফিগারের কথা অত চিন্তায় থাকে না। এত স্পাইসি খাবার আমার পছন্দ নয়। আমি একটু টেস্ট করছি।
—আচ্ছা। খাওয়ার জন্য তোমাকে জোর করব না।
—তুমি আমাকে গল্প শোনাবে বলেছিলে। গল্প কি রেডি আছে!
—উফ, তুমি একদম প্রফেশনাল রাইটারের মতো কথা বলছ আমার বাড়ি এসে। সময় কি পেরিয়ে গেছে গল্প শোনানোর! আমার পরিচয় তো প্রফেশনাল রাইটারেরই।
—একদম স্মার্টলি উত্তর।
কফি, কাটলেট, কবিরাজির পর্ব শেষ হলে মাধবীলতা রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে পরাগের হাত ধরে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, “ওঠো। এসো আমার ঘরে এসো।” সোফা ছেড়ে পরাগ উঠতে বাধ্য হল।
মাধবীলতা পরাগকে নিজের বেডরুমে নিয়ে গেলেন। তিনি খাটের উপর পরাগকে বসতে দিলেন। তিনি পরাগের শরীর ঘেঁষে বসে বললেন, “আমার গল্প বড়ো সাদা-কালো। পরাগ, এত রোম্যান্টিক লেখা তোমার কলমে আসে কী করে! তোমার উপন্যাসের প্রত্যেকটা নায়ককে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে জানো। কেন এমন শরীর মন আনচান করে?’ পরাগের কাঁধে বাম হাত রেখে তিনি বললেন, “আমার দিকে তাকাও।”
মাধবীলতার স্পর্শে পরাগের একটা অস্বস্তিবোধ করছিল। পরাগ বললেন, ‘আমার একটু তাড়া আছে। তোমার লেখাটা বার করো।’ মাধবীলতা পরাগের ঠোঁট হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। পরাগকে বিছানায় ঠেলে ফেলে তিনি বললেন, ‘চুপ। আমার কাছে কোনও বাহানা নয়। তুমি আমার গল্প লিখবে। আমি তোমার উপন্যাসের চরিত্র হব।”
তার বুকের শাড়ির আঁচল খসে পড়ল। অর্ধউন্মুক্ত বুকে তিনি পরাগের হাতটা জোর করে চেপে ধরে বললেন, ‘আমার মনে ঝড় উঠেছে দ্যাখো। এই ঝড় একমাত্র তুমিই থামাতে পারো।”
পরাগ জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী করছ! কেন আমাকে এসব বলছ?”
মাধবীলতা বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ‘কেন বলছি বুঝতে পারো না! আমি ক্ষুধার্ত। তোমার এত কাছে এসে আমার বুকে ছাইয়ের ভিতর চাপা পড়ে থাকা আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলছে। এই আগুন সবকিছু ছারখার করে দিতে চায়। আমি চাই যে, আমার হৃদয়ের অতলে লুকানো যত অনুভূতি তুমি বার করে আনো।”
পরাগ মাধবীলতাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার স্পর্শে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। একবার ভেবে দেখেছ কি, তোমার আমার বয়সের তফাৎ? এটা পাগলামো।’
মাধবীলতা তার শাড়ির আঁচল গায়ে তুলে পরাগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার তোমাকে ভালোলাগাটা পাগলামো! তোমার লেখা গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলো তো তাহলে সকলেই বদ্ধ পাগল।”
পরাগ বললেন, “ওটা সাহিত্য। আমি বুঝতে পারছি না যে, তোমার মতো একজন কেন এসব বলছে!”
মাধবীলতা দু-হাতে পরাগের দু-গালে হাত দিয়ে বললেন, ‘আমি বেশি সময় চাইছি না। কয়েক ঘণ্টা সময় আমাকে দাও। তুমি জানো না, একাকীত্বের চেয়ে বড়ো যন্ত্রণা কিছু নেই। বাইশ বছর ধরে এই যন্ত্রণায় আমি কাতর। যেদিন থেকে বিভিন্ন ম্যাগাজিনের পাতায় তোমার ছবি দেখেছি, সেদিন থেকে আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।’
(ক্রমশ…)