মাধবীলতার পাশে পরাগ অধিকারী বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। পরাগ অধিকারীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মাধবীলতা নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘আপনি কি চুপচাপ থাকতে ভালোবাসেন?’

পরাগ অধিকারী স্মিত হেসে বললেন, ‘না, তা নয়।”

—একটা কথা বলি, আমি বেশিক্ষণ ‘আপনি’-তে থাকতে পারি না। যে-কোনও মুহূর্তে ‘তুমি’-তে ফিরতে পারি। তাছাড়া বয়সে ছোটো কাউকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেও কিন্তু কিন্তু ঠেকে।

–আমাকে ‘আপনি’ না বলে ‘তুমি’-ই বলুন।

—তোমাকে আর একটা পরিচয় দিই আমার। আমার মেয়ে রম্ভা। তুমি পুরোদমে লেখার আগে যেখানে চাকরি করতে সেখানে ও চাকরি করত। রম্ভা তোমার কথা খুব বলত। অবশ্য রম্ভা জব জয়েন করার দু-বছরের মধ্যেই তুমি জব ছেড়ে দাও।

—রয় গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিতে আমি চার বছর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পোস্টে ছিলাম। আপনি রম্ভার মা জেনে ভালো লাগল। —ওহ, এই সেলেব্রিটি লোকজনরা মানুষকে আপন ভাবতে পারে না। বৈঠকখানার লোকের মতো দীর্ঘসময় আপনি, আজ্ঞে ইত্যাদি চালায়। আমাকে কি তুমি বলা যায় না? বয়সের গণ্ডি পেরিয়ে কি বন্ধু ভাবা যায় না?

—আচ্ছা ঠিক আছে। ‘তুমি’-ই বলব।’

পরাগের মুখ থেকে মাধবীলতা কথাটা শুনে সহাস্যে বললেন, ‘দ্যাটস লাইক আ গুড বয়। আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার একটা অনুরোধ আছে। তোমাকে রাখতেই হবে পরাগ। পরশু সানড়ে সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে তোমার চায়ের নিমন্ত্রণ। শুধু চা নয়, আমার লেখা একটা বড়ো গল্প আছে। সেটা তোমাকে একটু চেক করতে হবে। এটাই ধরো তোমার মূল কাজ।’

পরাগ আমতা আমতা করে বললেন, ‘পরশু! দেখছি।”

মাধবীলতা পরাগের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে জোরাজুরির সুরে বলল, “দেখছি নয়। কথা দাও আসবে।”

—আচ্ছা যাব।

গাড়িতে যেতে যেতে দু’জনের ফোন নাম্বার বিনিময় হল।

মাধবীলতা বললেন, “একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। পরাগ, বাড়ি না গিয়ে কোথায় যাবে এখন?’

পরাগ স্মিত হেসে বলল, ‘এক বন্ধুর বাড়ি।’

গাড়ি সল্টলেক ঢুকতেই পরাগ বললেন, “এখানে রাখো। আমি নামব।” গাড়ি থেকে নেমে তিনি মাধবীলতাকে বললেন, “ধন্যবাদ দিদি পৌঁছে দেবার জন্য।’

মাধবীলতা বললেন, “ঠিক আছে। রবিবার আসছ কিন্তু আমার বাড়ি।”

পরাগ দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন। মাধবীলতা যখন বাড়ি ফিরলেন তখন ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘর ছুঁয়েছে।

বাড়ি ফিরে স্নান সেরে বার্থ রোব গায়ে জড়িয়ে মাধবীলতা তার ঘরে ঢুকলেন। স্বামীর তৈরি প্রাসাদোসম তিনতলা বাড়িতে তিনি একেবারে একা। একমাত্র মেয়ে রম্ভা দশ বছর চাকরিসূত্রে বেঙ্গালুরুতে থাকে। মাধবীলতার স্বামী বাইশ বছর হল মারা গেছেন। বড়ো বাড়ির নির্জনতা মাধবীলতাকে যেন একাকীত্বের গহ্বরে নিয়ে যায়। দিনের বেলায় তবু কাজের দুটো লোক থাকে। সন্ধের পর বাড়ি যেন নিস্তব্ধতার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমায়। বড়ো বাড়িতে মাধবীলতা সম্পূর্ণ একা। তার অর্থের কোনও অভাব নেই। বলা যায়, অর্থের প্রাচুর্য এতই যে, মাধবীলতার পরবর্তী দুই প্রজন্ম উপার্জন না করলেও স্বাচ্ছন্দ্যেই চলে যাবে।

মাধবীলতার সঙ্গীর অভাব। তার সুখ-দুঃখের কথা বলার লোকের অভাব। বাইশ বছর তিনি যে কীভাবে একা কাটিয়েছেন তিনিই জানেন। কথা বলার মনের মতো সঙ্গী পেলে তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তার বয়স হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আজ পরাগের মতো পুরুষের মুখ থেকে তাঁকে ‘দিদি’ সম্বোধন একদম মেনে নিতে পারেননি। বন্ধু হিসাবে পরাগ তো তাকে নাম ধরেই ডাকতে পারতেন।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বার্থ রোব ছেড়ে মাধবীলতা অন্য পোশাক পরতে গিয়ে অর্ধ অনাবৃত শরীর দেখে কিছুটা শঙ্কিত হলেন। মাধবীলতার পূর্বের চেহারার সঙ্গে বর্তমান চেহারার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা তার সাতাশ বছর বয়সের বড়ো করে বাঁধানো ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। বর্তমানে তার বয়স আটান্নর ঘরে পা দিয়েছে। বার্ধক্য নির্মম আঁচড় কেটেছে তার সর্বাঙ্গে। কাঠ পালিশের মতো জৌলুস টানটান চামড়ায় কোঁচকানো ধুতির মতো অজস্র ভাঁজ পড়েছে। অমাবস্যার মতো ঘন কালো লম্বা চুল পুজোর শুভ্র চামরের মতো রং নিয়েছে। সেই চুল ঢাকতে নানান রং ব্যবহার করলেও সে রং বড়োই ক্ষণস্থায়ী।

মাধবীলতার মুক্তোর মতো দাঁতগুলো অকালে সামনে কয়েকটা পড়ে যাওয়ায় বাঁধানো দাঁতে কাজ চালাতে হয়। স্বপ্নে ভাসা টানা টানা দুটি চোখ আজ নিস্তেজ, জৌলুসহীন। চোখের নীচে কালি পড়েছে। তার পূর্বের মেদহীন শরীর দখল করে ফেলেছে কিছু অপ্রয়োজনীয় চর্বি। গালের কোঁচকানো চামড়ায় পুরনো বসন্তের দাগ এবং মেচেতা সখ্যতা করে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রকটিত হয়েছে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। মাধবীলতার অজান্তেই ধীর পায়ে বার্ধক্য যৌবনকে চুরি করেছে। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। মাধবীলতা একটা শীত ঘুম থেকে ওঠা সাপের মতো দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন।

রবিবার সকাল থেকে মাধবীলতার ব্যস্ততার সীমা নেই। ঔপন্যাসিক পরাগ অধিকারী তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আজ সন্ধ্যা সাতটায় আসছেন। রান্নার লোককে দিয়ে অনেকরকমের পদ রান্না করিয়েছেন মাধবীলতা। কাজের দুটো লোককে বিকালের আগেই তিনি বিদায় করে দিয়েছেন। বার্ধক্যের কর্কশ নখরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া শরীরকে মাধবীলতা মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছেন। পেস্তা রঙের এমব্রডারি ডিজাইন করা শাড়িতে তিনি নিজেকে আবৃত করেছেন। গালের উপর গাঢ় মেক-আপ আবরণ তার বয়সকে গোটা দশ বছর কমিয়ে দিয়েছে। তার রং করা চুলের খোঁপায় বেঁধেছেন জুঁই ফুলের মালা। ঘন বাদামি লিপস্টিক তার ঠোঁট রাঙিয়েছে। নিস্তেজ দুটি চোখ ঘন কাজল আর মাসকারায় মোহময়ী রূপ নিয়েছে। ঈষৎ কোঁচকানো চামড়ায় ঢাকা মাংসল হাতে সোনার ভারী কঙ্কন। আঙুলে হিরের আংটি। গলায় মুক্তোর হার। কানে মীনা করা সোনার দুল। চওড়া কপালে বড়ো শাড়ির রঙের সঙ্গে মানানসই হালকা সবুজ টিপ। পায়ে একজোড়া রুপোর নূপুর। সবমিলিয়ে মাধবীলতা নিজেকে সুসজ্জিত করতে কোনও খামতি রাখেনি। বার্ধক্যকে ঢাকতে তার প্রচেষ্টা নেহাৎ কম নয়।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...