মনে রাখবেন, ড্রাগ অ্যালার্জি সাধারণ বিষয় নয়। যদিও সবার ড্রাগ অ্যালার্জির সমস্যা থাকে না, কিন্তু যাদের এই সমস্যা থাকে, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত সর্বদা। আপনার ড্রাগ অ্যালার্জি আছে কিনা এবং কোন কোন ওষুধে অ্যালার্জি-র সমস্যা হতে পারে, তা নির্ণয় করা আবশ্যক।
আপনার ইমিউন সিস্টেম, যা সংক্রমণ এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সেই লড়াই করার ক্ষমতা হারাতে পারেন ড্রাগ অ্যালার্জি-র শিকার হলে। এই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায়— শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কালো বা লালচে দাগ এবং ফুসকুড়ি হতে পারে। এছাড়া জ্বর এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যাও হয় অনেক সময়। শুধু তাই নয়, যাদের ড্রাগ অ্যালার্জি-র সমস্যা আছে, তারা যদি অ্যালার্জি টেস্ট করিয়ে সতর্কতা অবলম্বন না করেন, তাহলে বড়ো ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে, এমনকী জীবনহানিও ঘটতে পারে। তাই, আগাম সতর্কতা জরুরি। এই বিষয়ে, টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হাসপাতাল-এর সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দীপংকর পাল-এর বক্তব্য এবং পরামর্শ তুলে ধরা হচ্ছে বিস্তারিত ভাবে।
ড্রাগ অ্যালার্জি কী?
কোনও কোনও মেডিসিন অর্থাৎ ওষুধ সেবন করলে কিংবা ইনজেক্ট করলে, শরীরে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আর এই এফেক্ট-কেই বলা হয় ড্রাগ অ্যালার্জি। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ বা ওষুধের একটি গ্রুপের অ্যালার্জি-র প্রতিক্রিয়াকে ড্রাগ অ্যালার্জি বলা হয়। এটি ওষুধ খাওয়ার পরপরই ঘটতে পারে কিংবা কিছুদিন পরেও হতে পারে। কিছু ওষুধ ইনজেক্ট করা হয় শরীরে, আবার কিছু ওষুধ সেবন করা হয় এবং এর ঠিক পরেই অনেকের অ্যালার্জি-র সমস্যা হতে পারে।
ড্রাগ অ্যালার্জি কখনও সামান্য প্রভাব ফেলে শরীরে, আবার কখনও গুরুতর ক্ষতি করে দিতে পারে। কার শরীরে কতটা কী প্রভাব ফেলবে, তা আগে থেকে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। অনেক সময় এমনও দেখা গেছে যে, ড্রাগ অ্যালার্জি এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে, রোগীকে হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি করতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতি হলে রোগীকে দীর্ঘ সময়ের জন্য অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ওষুধ এবং অক্সিজেন প্রয়োগ করতে হতে পারে।
ড্রাগ অ্যালার্জি–র কারণ
এখন নানারকম কারণে অনেকেই ড্রাগ অ্যালার্জির শিকার হচ্ছেন। সত্যি বলতে কী, অনেক ওষুধই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত নয় বর্তমানে। এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে হতে পারে, আবার অনেক সময় বিলম্বিত হতে পারে। আসলে, অ্যালার্জি হল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে একটি, যা আমরা সাধারণত কোনও ওষুধ ব্যবহার করার পরে দেখতে পাই কিংবা অনুভব করতে পারি। যে-সমস্ত ওষুধে সাধারণত অ্যালার্জির সমস্যা হতে পারে, ওষুধের সেই গ্রুপগুলি হল—
O মৃগীরোগের ওষুধ
O সালফার অ্যান্টিবায়োটিক রেয়ার অ্যান্টিবায়োটিক
O ভ্যানকোমাইসিন
O মিনোসাইক্লিন
O যক্ষ্মা রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার ওষুধ
O এইচআইভি-র ওষুধ
O কিছু ব্যথানাশক ওষুধ
O ইউরিক অ্যাসিড-এর সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার ওষুধ ইত্যাদি।
উপসর্গ
ড্রাগ অ্যালার্জি বিভিন্ন ভাবে দেখা দিতে পারে। কখনও এটি শুধুমাত্র ত্বকের উপর প্রভাব ফেলে, কখনও ফুসফুসের উপর প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ শ্বাসকষ্ট এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়। আবার কখনও রোগীর জ্বর, অস্বস্তি, মাথাব্যথা, খিদে না পাওয়া এবং কখনও আবার বমিও হতে পারে।
আবার কখনও ত্বকের উপর কালো স্পট দেখা দেয় কিংবা ফুসকুড়ি হতে পারে। আর এই ফুসকুড়ি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। শুধু তাই নয়, ত্বকের উপর লালচে দাগ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। হতে পারে চুলকানিযুক্ত লাল প্যাপিউলস এবং আঁশযুক্ত ক্ষত। এই সমস্যা কখনও গুরুতর রূপ নিতে পারে, যদি ওই অ্যালার্জিযুক্ত ওষুধ খাওয়া বন্ধ না করেন রোগী। আর একবার ড্রাগ অ্যালার্জি-র সমস্যা হলে, তার কুপ্রভাব দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থাকতে পারে।
ড্রাগ অ্যালার্জি-র সমস্যা আছে অথচ তা যদি তিনি বুঝতে না পেরে বারবার অ্যালার্জিযুক্ত ওষুধ খেয়ে যান, তাহলে যৌনাঙ্গের ত্বকে বারবার ফুসকুড়ি-র সমস্যা হতে পারে এবং যৌনাঙ্গের ত্বক ফেটে গিয়ে জ্বালা করতে পারে। অবশ্য ত্বকের ফুসকুড়ি ছাড়াও, মুখ-গহ্বরে ঘা হতে পারে, মিউকোসাল ডিসক্যামেশন এবং আলসার হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। গলায় ছড়িয়ে থাকা অ্যালার্জি কিংবা আলসারের ফলে খাবার খেতে কিংবা জলপান করতে গিয়েও কষ্ট হতে পারে। মুখ-গহ্বরে ফুসকুড়ি, আলসার এমনকী রক্তপাতও ঘটতে পারে অনেক সময়। নাক দিয়ে শ্বাস নিতে গিয়েও অসুবিধা হতে পারে।
ড্রাগ অ্যালার্জি-র সমস্যা থাকলে চোখ লাল হয়ে যেতে পারে, চোখ চুলকাতে পারে এবং চোখ থেকে জল পড়তে পারে অনবরত। সেইসঙ্গে, শ্বাসযন্ত্রের সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হাঁচি হতে পারে এবং রাইনোরিয়ার সমস্যা হতে পারে। কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, বুকে চাপ অনুভব করা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি সমস্যা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এছাড়া, যারা হাঁপানি রোগী, তাদের হাঁপানির সমস্যা আরও গুরুতর রূপ নিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আবার রোগীকে অক্সিজেন দিতে হতে পারে।
ওষুধের অ্যালার্জি গুরুতর হলে রক্তচাপ বাড়তে বা কমতে পারে। রক্তচাপ কমে যাওয়াকে সাধারণত অ্যানাফিল্যাকটিক শক বলা হয়। এর জন্য অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি, শিরায় স্যালাইন, স্টেরয়েড, অ্যাড্রেনালিন, অক্সিজেন প্রভৃতি প্রয়োগ করতে হতে পারে।
চিকিৎসা
রোগীকে নতুন কোনও ওষুধ দেওয়ার আগে, সঠিক অ্যালার্জি রিপোর্ট নেওয়া আবশ্যক। আর ড্রাগ অ্যালার্জির উপসর্গ দেখা দিলে, অবিলম্বে চিকিৎসককে তা জানানো উচিত এবং সঠিক চিকিৎসাকে মাধ্যম করা উচিত। যদি ড্রাগ অ্যালার্জির সমস্যা থাকে, তাহলে নতুন ওষুধ গ্রহণ করার আগে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। বিশেষকরে হাঁপানি কিংবা চর্মরোগের সমস্যা থাকলে আরও বেশি সতর্ক থেকে ওষুধ দেওয়া উচিত। যেমন— সালফার জাতীয় ওষুধগুলি অ্যালার্জির সমস্যা বাড়াতে পারে। তাই, অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াও চিকিৎসকদের মাথায় রাখতে হবে, আর কোন ওষুধে সালফারের অণু থাকে।
চুলকানি, ত্বকে জ্বালাপোড়া, ত্বকের উপরি আস্তরণ খসে পড়া, মুখের বা ত্বকের আলসার, ত্বক বা যৌনাঙ্গে ফোসকা, জ্বর, ক্লান্তি এমনকী জন্ডিসও হতে পারে ড্রাগ অ্যালার্জি-র এফেক্টে। তাই, এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে, তখনই আপনাকে সমস্ত ওষুধ গ্রহণ বন্ধ করতে হবে এবং ওই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, তা তখনই চিকিৎসকের থেকে জেনে নিতে হবে। চিকিৎসক আপনাকে অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ওষুধ দিতে পারেন। গুরুতর ক্ষেত্রে ব্যথা-যন্ত্রণা কমানোর ওষুধও দেওয়া হতে পারে। তবে ড্রাগ অ্যালার্জি-র কুপ্রভাব যদি ত্বকে কিংবা মুখ-গহ্বরে পড়ে, তাহলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসক আপনাকে লোশন, ইমোলিয়েন্ট প্রভৃতি দিতে পারেন।
আর যদি গায়ে জ্বর থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল দিতে পারেন আপনার চিকিৎসক। কিন্তু ড্রাগ অ্যালার্জি-র এফেক্ট যদি গুরুতর হয়, তাহলে তখনই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। কারণ, হাসপাতালে ভর্তি করলে চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারেন। যেমন— – রোগীকে আইসিইউ-তে নিয়ে অক্সিজেন, ইনহেলার, স্যালাইন এবং অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে।
পরিশেষে যে বিষয়টি জেনে রাখা উচিত, তা হল— ড্রাগ অ্যালার্জি-র উপসর্গ দেখা দিলেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যালার্জি টেস্ট করিয়ে নিন এবং যে-সমস্ত ওষুধে আপনার অ্যালার্জি আছে, সেই সমস্ত ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে হবে ভবিষ্যতে। শুধু তাই নয়, অ্যালার্জিযুক্ত ওষুধের লিস্ট সর্বদা সঙ্গে রাখা উচিত এবং অসুস্থ হলে ওই অ্যালার্জিযুক্ত ওষুধের তালিকা চিকিৎসককে দেখিয়ে নেওয়া আবশ্যক।