সুমনা বইয়ের দোকানে দরদাম করছে। দরদাম না করে কিছু কিনতে মন সায় দেয় না তার। তা সে যত তুচ্ছই হোক বা জীবনদায়ী ওষুধই হোক না কেন। বাজারে এক আঁটি শাকের দাম দোকানি পাঁচ টাকা চাইলে, সুমনা চার টাকা বলবে। পরে অবশ্য পাঁচ টাকাতেই নেবে।
সুমনা বলল, ‘এই সমস্ত সাবজেক্টের বইতে ত্রিশ থেকে চল্লিশ পার্সেন্ট ছাড় পাওয়া যায়। আপনি দশ পার্সেন্টের বেশি দিতেই চাইছেন না! বেশ তো দাদা আপনি।’
মধ্য ত্রিশের টান টান মেদবর্জিত চেহারার সুমনার মুখে ‘দাদা’ শব্দটি শুনে বৃদ্ধ দোকানির মন বুঝি একটু গলল। আগের চেয়ে চওড়া হাসি হেসে উত্তর দিল, কিছু বইতে ছাড় তো সাবজেক্টের উপরে দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় সেলের উপরে। এই বইটির একদম সেল নেই। গত পাঁচ বছরে একটিও কপি বিক্রি হয়নি। দশ কপিই ধরা আছে। নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করলেও হিসেবমতো লস হবে। ঠিক আছে আপনাকে পনেরো পার্সেন্ট ছাড় দিলাম। একশো সত্তর টাকা দিন।
সুমনা এমনটাই আন্দাজ করছিল। দরদামে ওর নিজের সূত্র আছে। সেই সূত্র অনুযায়ী বহুদিনের অভ্যেসে সে বুঝে যায় দোকানি যখন নামতে থাকে তখন ক্রেতাকে ডুব দিতে হয়। অর্থাৎ আগে যা দাম বলেছিল, তার চেয়ে কিছুটা কম বলে চুপ করে জলের তলায় ঘাপটি মেরে থাকার মতো থাকতে হয়। তার সঙ্গে মুখে বিতৃষ্ণার ছবি ফুটিয়ে তুললে কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। সুমনা সূত্র মিলিয়ে তেমনটাই করল। চুপ করে থাকল।
দোকানি অন্য দু’জন খদ্দের সামলে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। যাক না হয় আমারই লস হোক। আপনি আরও কুড়ি টাকা কম দিন। দিন, দেড়শোই দিন। কী এবার নিশ্চয় আপনি খুশি?”
সুমনার খুশি বোঝা গেল না। দরদামের সময় মুখে খুশি খুশি ছবি ফুটিয়ে তুলতে নেই। দোকানি বুঝে গেলেই সমস্যা। খুশি হলেও জোরসে খুশি চেপে রাখতে হয়। নইলে দোকানি পেয়ে বসবে। সে চট করে একশো চল্লিশ টাকা দোকানির হাতে গুঁজে দিয়ে, ব্যাকডেটেড সাবজেক্টের বই, একশো টাকা হলেই ঠিক ছিল….। বলতে বলতে বইটি হাতে নিয়ে হন হন করে হাঁটা দিল বড়ো রাস্তার দিকে। দোকানি ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। একসময় চোখ ফিরিয়ে নিল।
দাপুটে স্বভাবের মেয়ে সুমনা। ছোটোবেলায় গাছে উঠে ফল পেড়ে খাওয়া, সাঁতরে পুকুর পার হওয়ায় ওর জুড়ি মেলা ভার ছিল। সংসার জীবনেও ওর দাপট অব্যাহত। সন্দীপন অবশ্য দাপুটে স্ত্রী পেয়ে বেশ খুশি। সংসার জীবনটা বাইরে থেকে দেখতে এক রকম ভিতর থেকে অন্য রকম। ঠিক নারকেলের উলটোটা যেন। বাইরে থেকে তুলতুলে মনে হলেও ভিতরে বেশ শক্ত। বাইরেটা পুরুষ, ভিতরটা নারী যদি হয় অর্থাৎ সংসারের হাল যদি শক্ত করে ধরে নারী, তবেই সংসার সুখের হয়। সংসার আসলে পরিপাটি সাজানো ঘর-দোর। নারীই পারে সমস্ত ঝুলকালি ঝাঁটাপেটা করে তকতকে করে তুলতে। সন্দীপন-সুমনার সংসারে দুঃখের চোরাস্রোত থাকলেও, সুমনার দাপট থাকলেও, সুখও ছিল।
সুখ বড়ো চঞ্চল। শিশুর চেয়েও চঞ্চল। ধরে রাখা মুশকিল। দাপুটে সুমনার সংসারে সুখের ব্যাঘাত ঘটল৷ কোথা থেকে উড়ে এল একটি পাখি। ওলট পালট করে দিল সবকিছু।
ঘটনার সূত্রপাত তিনদিন আগে। সকালে চা করল সুমনা। সব ঠিকঠাক। ঘণ্টা দুয়েক পরে রান্নার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে সুমনার চোখে পড়ল গ্যাসের ওভেনের উপরে উলটে থাকা কলসির মতো কিচেন চিমনিতে এই সামান্য সময়ের মধ্যে কী করে যে একটি পাখি খরকুটো দিয়ে বাসা বানিয়ে ফেলেছে! প্রথম দর্শনে সুমনা ভেবেছিল দু-একবার হুশ হাশ করলেই উড়ে যাবে। সুমনা তাই করল। ওড়া তো দূরের কথা, পাখিটি বিন্দুমাত্র নড়ল না। পাখিটির সাহস দেখে ওর মনে সন্দেহ হল। খুব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল খড়কুটোর বাসায় তিনটে ছোট্ট ছোট্ট ডিম। সেই ডিমের উপর বসে আছে পাখিটি। মুহূর্তে সুমনা বুঝল পাখিটি মা পাখি। সন্তানের জন্ম দিতে সমস্ত ভয়কে অগ্রাহ্য করে ডিমে তা দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে এও নিশ্চিত হল যে, ডিম ফুটে বাচ্চা না বের হওয়া পর্যন্ত পাখিটি নড়বে না। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত মানুষকে খুব কম সময়ের মধ্যে নিতে হয়। অবশ্যই সে সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়া আবশ্যক। সুমনা আর কিছু বলল না। ভয় দেখাতে বা জোর করে পাখিটিকে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল না।
সন্দীপন বাজার থেকে ফিরলে সুমনা সমস্ত ঘটনা জানাল। সন্দীপনকে রান্নাঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে বাসা দেখিয়ে বলল, ‘বাড়িতে দু- একদিন রান্না না হলেও আমরা বাইরের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে পারব। কিন্তু এই অবস্থায় বাসাটা ভেঙে দিলে মাতৃত্বের সুখ ও স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত পাখিটি আর নাও বাঁচতে পারে। তাছাড়া তিনটে প্রাণের পৃথিবীর আলো দেখার আগেই হত্যা করা ঠিক হবে না। তুমি কী বলো?’
সন্দীপনের মুখে বিরক্তির ছাপ। কিন্তু সুমনার মুখের উপর কিছু বলল না। মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠেছে মোহিত তালুকদার। অফিসের সহকর্মী। লাল বোতাম প্রেস করে ঘরের বাইরে যেতে যেতে বলল, ‘ডিম ফোটানোর আর জায়গা পেল না! যত্তসব।’
সন্দীপনের বিরক্তি বেশ বুঝতে পারল সুমনা। সে নিজেও ভেবে দেখল সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটের বাইরেই পাখি মানায়, ভিতরে নয়। তাছাড়া আজ একটি পাখি বাসা বেঁধেছে, কাল হয়তো দলে দলে আসবে। তখন সামাল দেওয়াই মুশকিল হবে। অতএব শুরুতেই তাড়িয়ে দেওয়া ভালো। কিন্তু পাখিটির মাতৃত্ব সুমনার মনে গভীর ছাপ ফেলল। এই অবস্থায় কি তাড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে? ছোটোবেলায় ঠাকুমা বলত, গৃহস্থের বাড়িতে গর্ভবতী কেউ এলে তাকে না খাইয়ে যেতে দিতে নেই। এমনকী গর্ভবতী আশ্রয় চাইলে, গৃহস্থের উচিত আশ্রয় দেওয়া। সন্তান জন্মের পরে কেউ মা হয় না। মাতৃত্বের আসল অনুভূতি সন্তান জন্মের আগে। গর্ভবতী অবস্থাতেই। পৃথিবীর সব মা একসুতোয় বাঁধা, মাতৃত্ব। তা সে মানুষ হোক বা পাখি।
(ক্রমশ…)