সমরের মনে হল কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করল— আপনার নাম আপনার মনে পড়ছে কি? —পড়েছে, হ্যাঁ, অনামিকা। ডাক্তারবাবু তো তাই বলেই ডাকছিলেন।
—আপনার কি কিছুই মনে পড়ছে না? কোথায় থাকেন, আপনার নাম কী ইত্যাদি।
—আমার আগের কিছুই তো মনে পড়ছে না। ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি উত্তর দিলেন মাথায় চোট-টা একটু বেশি লেগেছে তো, তাই এমন লাগছে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কথাগুলো শুনেই সমর বেশ গম্ভীর হয়ে গেল, বুঝতে পারল যে, ঘটনা এবার অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। তাই কী করবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে গাড়ি চালাতে লাগল। সমরের মনে নানা প্রশ্ন, নানা দ্বন্দ্ব উঁকি মারতে লাগল। এসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে বাড়িতে পৌঁছে গেল। ভাবল খেয়ে দেয়ে ভালো করে একটা ঘুম মারলেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।
( চার )
খাওয়াদাওয়ার পর সমর অনামিকাকে খাটে বিছানা করে দিয়ে, নিজে মাটিতে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে নানা অজানা আশঙ্কার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল অনামিকার ডাকে।
—উঠে পড়ো। চা খেয়ে নাও।
সমর চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অনামিকা চা বানিয়ে নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সমর নিঃশব্দে যখন চা-এ চুমুক দিচ্ছে, তখন সব নীরবতা ভঙ্গ করে অনামিকা বলে উঠল— অ্যাই জানো, গতকাল বা তার আগের দিনের কোনও ঘটনাই আমার মনে পড়ছে না। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে?
সমর দেখল এই সুযোগ। সে সমস্ত ঘটনা অনামিকাকে শোনাল, কিন্তু মনে হল অনামিকা যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। অনামিকা বলে উঠল— তাহলে ডাক্তাররা কি মিথ্যে বলল যে তুমি আমার স্বামী!
সমর কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তাই চুপ করে রইল।
এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছু দিন। ওরা দু’জনেই বেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। একে অন্যকে বুঝতে পারছে। ঘনিষ্ঠতাও বেড়েছে। সমর আর আজকাল অফিসে লেট সিটিং করে না। অনামিকাকে না দেখলে যেন মনটা কেমন ছটফট করে। তাহলে কি অনামিকার ব্যপারে দুবর্লতা দেখা দিল।
অন্যদিকে অনামিকারও ঠিক তেমন অবস্থা। একই ঘরে একজন খাটে শোবে আর অন্যজন নীচে বিছানা পেতে শোবে তা কী করে হয়! আজকাল ঘরের সব কাজকর্ম অনামিকাই করে। আগুনের সামনে ঘি থাকলে যেমন আপনা থেকেই জ্বলে ওঠে, ঠিক তেমনই একদিন সমর অফিস থেকে ফেরার পর অনামিকা বলল – তোমার সঙ্গে আজ কথা আছে। আগে হাত, পা ধুয়ে নাও।
অনামিকা রান্নাঘর থেকে ততক্ষণে চা বানিয়ে নিয়ে এল। দু’জনেই চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প শুরু হল। অনামিকা বলে উঠল— শোনো, আমরা দু’জনে
স্বামী-স্ত্রী হয়ে এভাবে আলাদা আলাদা থাকব, এ কীভাবে সম্ভব?
—অনামিকা, আমি জেনেশুনে এমন কিছু করতে চাই না যাতে তোমার বা আমার কোনও ক্ষতি হোক। তবে তুমি চাইলে এ ব্যাপারে আমরা ম্যারেজ রেজিস্টারের কাছে গিয়ে পরামর্শ নিতে পারি। উনি যদি বলেন কোনও আপত্তি নেই তবে আমরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করতে পারি।
মনে হল অনামিকার কথাটা পছন্দ হয়েছে। পরের দিন সমর আর অনামিকা একজন ম্যারেজ রেজিস্টারের সঙ্গে দেখা করে সব পাকা করে এসেছে এবং কিছুদিনের মধ্যে ওদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজও উনি করিয়ে দিলেন। এরপর থেকে ওদের সংসার বেশ আনন্দেই কাটছিল। ছুটির দিন হলেই ওরা দু’জনে গাড়ি নিয়ে বেড়াতে চলে যেত লং ড্রাইভে।
এক রবিবার সমর বলল— অনামিকা, চলো আজ তোমাকে বনগাঁ-তে বাংলাদেশের সীমান্তটা দেখিয়ে নিয়ে আসি। আসলে আমিও বই-এ ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এর কথা পড়েছি কিন্তু কখনও দেখিনি। চলো, আজ বনগাঁ ঘুরে আসি। শুনেছি ওখানে নাকি খুব ভালো ও সস্তায় মিষ্টি পাওয়া যায়। যাবে নাকি সেখানে?
—আমি অত বুঝি না বাপু। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানেই যেতে রাজি। তুমি সঙ্গে থাকবে এটাই অনেক। আমি আর কিছু চাই না। আমি আর পুরোনো জীবনেও ফিরে যেতে চাই না।
সকালবেলায় প্রাতঃরাশ, স্নান সেরে দু’জনেই চলল বনগাঁর উদ্দেশ্যে। রাস্তায় যেতে যেতে দু-দিকে বড়ো বড়ো গাছ আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে দু’জনেই খুব খুশি হচ্ছিল। হঠাৎ ওদের চোখে পড়ল একটা বড়ো ট্রাক ওদের উলটোদিকের গাড়িটাকে ওভারটেক করতে গিয়ে ওদের দিকেই ধেয়ে আসছে। সমর নিমেষের মধ্যে গাড়ির স্টিয়ারিংটা বাঁদিকে ঘুরিয়ে নিল কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারল না। গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা খেল রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বড়ো গাছের সঙ্গে। এর পর আর সমরের কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে দেখল হাসপাতালের বিছানায়। জ্ঞান ফিরতেই নার্সকে জিজ্ঞাসা করল। আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি কেমন আছেন।
—ওঁকে তো আজ সকালে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওঁর মাথায় একটু আঘাত ছিল। ওটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি তিনদিন অচৈতন্য অবস্থায় ছিলেন।
সমর কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু অবাক হল অনামিকা তাকে একটিবার দেখতেও এল না! তাহলে ও গেল কোথায় ? ও তো এ শহরের কিছুই চেনে না।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিন রিসেপশন থেকে খবর নিয়ে জানতে পারল অনামিকা ওর বাড়িতে ফোন করে ওর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তারাই নাকি ওর হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দিয়েছে। তাই সমরকে আর তার বিল দিতে হবে না। ওর নাম নাকি মধুছন্দা বলেছে। এর পর সমর পাগলের মতো খুঁজেও অনামিকার কোনও সন্ধান না পেয়ে অফিস থেকে দিল্লিতে ‘ট্রান্সফার’ নিয়ে চলে যায়। ওর স্মৃতি থেকে এখনও অনামিকার ছবি মুছে ফেলতে পারেনি। আজও রোজ বাড়ি ফিরে অনামিকার ছবি নিয়ে বহুক্ষণ কাটিয়ে দেয়। ছবির সামনে বসে চোখের জল ফেলে। কিছুতেই মন থেকে ভুলতে পারছে না তাকে। মনে হয় ওর মরুভূমির মতো জীবনে অনামিকা মরুদ্যান হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল।
এভাবে কেটে গেল দু’বছর। অনামিকার দেখা পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিল প্রায়। এমন সময় একদিন অফিসের এক সহকর্মী কৌশিকের বউভাতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে সমর চমকে উঠল। এ কী? এ তো অনামিকা। ওর বন্ধু তাহলে অনামিকাকেই বিয়ে করেছে। সমরের তখন বাকরুদ্ধ অবস্থা। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। শরীরে কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করছে। কাউকে কিছু না বলেই ধীর পায়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ কৌশিকের সঙ্গে দেখা। কৌশিক বলল— কিরে কোথায় চললি?
—আমার শরীরটা ভালো লাগছে না রে। বাড়ি যাচ্ছি। পরে একদিন হবে। আচ্ছা, তোর বউ-এর নাম কিরে?
—মধুছন্দা।
সমরের আর বুঝতে বাকি রইল না যে, অনামিকা তার জীবনে এখন অতীত। তাই ধীর পায়ে বিয়েবাড়ি থেকে ঘরে ফিরে এসে, অনামিকার সব ছবিগুলো নামিয়ে রাখল। অব্যক্ত এক গভীর বেদনায় চোখ জলে ভরে এল।
(সমাপ্ত)