মন্দিরের কাছে এসে গৌতম বাইক থেকে নেমে চারদিকটা একবার দেখে নিল। সামনেই সেই বিরাট লোহার দরজা। চারদিকটা একটা একমানুষ অবধি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভিতরে কয়েকটা বাড়ি, সম্ভবত এখানকার পুলিশ কর্মীদের থাকবার জায়গা। জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া রয়েছে। দরজাটা কি এমনি সময় খোলা থাকে? রাতে কি বন্ধ করে দেয়? সম্ভবত করে। তবে রাতের দিকে এই দিকটাতে কখনও আসেনি, বলা ভালো আসার প্রয়োজন হয়নি।

লোহার দরজাটার ওদিকে একটা ছোটো গুমটি আছে। কয়েকজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গৌতম তাদেরকেও একবার দেখে নিল। চারজন আছেন— একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক, একজন মহিলা আর দুটো বাচ্চা, একটা ছেলে ও একটা মেয়ে। মেয়েটা সেই ভদ্রমহিলার কোলে, বয়স খুব বেশি হলে দেড় থেকে দুই বছর হবে। একটু আগেই খুব কেঁদেছে। তার জেরটা তখনও ছিল। একটা ঘ্যানঘ্যানে ভাব বাচ্চা মেয়েটার মুখে ফুটে উঠেছে। তারা সবাই একটা ছোটোঘরের দিকে গেল।

গৌতম নিজের বাইকটা ঠেলে নিয়ে এসে দোকানের কাছাকাছি একটা গাছের নীচে দাঁড় করাল। হেলমেটটা খুলে সামনে তাকাতে আরেকটা বড়ো প্রাচীরের দিকে চোখ পড়ল। ওটাই সেই সংশোধনাগার। বাইকটাতে চাবি দিয়ে দোকানটার সামনে এসে দাঁড়াল। খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল, “দাদা, বলছিলাম, ভিতরে যারা আছেন, তাদের সঙ্গে দেখা করবার কোনও নিয়ম আছে কিনা কিছু বলতে পারবেন?”

একজন সেই দোকানের ভিতরে কিছু একটা কাজ করছিলেন। গৌতমের কথা শুনে খুব অদ্ভুত ভাবে উত্তর দিলেন,‘পারব, কিন্তু বলব না, কারণ ওটা আমার কাজ নয়। যদি বিড়ি, খৈনি বা অন্য কিছু কেনেন তাহলে বলবার চেষ্টা করতে পারি।”

গৌতম আর কথা বাড়াল না। সে নিজে বিড়ি বা খৈনির কোনওটাই খায় না। তাছাড়া এই সব ট্যারা কথাবার্তার লোকেদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে নেই, মাথা গরম হয়ে যেতে পারে। বাইকটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে সেই বড়ো প্রাচীরের দিকে কয়েকটা পা এগোতেই গুমটির ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘সামনের ঘরটাতে চলে যান।’

সেই চারজন ততক্ষণে ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। গৌতম ঘরটার কাছে আসতেই ভিতর থেকে শুনতে পেল, ‘ও বাবা, আধার কার্ড আনেননি ….

—না মানে, হঠাৎ করে…।

—কী করেছিল?

—ওই মানে তাসখেলার ওখানে…

—না না, শুধু তাস খেলা নয়, আরও কিছু আছে। আপনারা বলছেন না অথবা জানেন না।

গৌতম পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল। ঘরের ভিতরে সেই ভদ্রলোক ততক্ষণে কিছু একটা লিখতে লিখতেই কথাগুলো বলছিলেন। গৌতম গলাটা একবার ঝেড়ে নিজের উপস্থিতি বোঝাল। সেই ভদ্রলোক মাথা তুলে গৌতমের দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার?”

গৌতম একটু আমতা আমতা করে উত্তর দিল, “আমি একজনের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে এসেছি। আমার কলিগ, হয়তো এই জেলেই আছেন। কিন্তু কীভাবে দেখা হতে পারে…’

—আপনার কলিগ, কোথায় কাজ করেন?

—স্কুলে।

—আপনি টিচার, কোন স্কুলের?

গৌতম তার নিজের স্কুলের নামটা বলল।

ভদ্রলোক কিছু একটা লিখতে লিখতেই কথাগুলো বলছিলেন। গৌতমের পাশেই সেই চারজন ছিলেন। তাদের সঙ্গের দুটো বাচ্চার মধ্যে একটা খুব কাঁদছিল। আরেকজনের হাতে একটা চকোলেট ছিল। ঘরের ভিতর থেকে সেই ভদ্রলোক ওনাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘সামনের সপ্তাহে কেউ এলে তার হাত দিয়ে ভোটার বা আধার কার্ড কিছু একটা পাঠিয়ে দেবেন।”

—আধারকার্ড তো পুলিশের কাছে। বয়স্ক ভদ্রলোক উত্তর দিলেন। মানে ছেলের মানিব্যাগে থাকে। পুলিশ, মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন— সব কিছু নিয়ে রেখেছে।

ঘরের ভিতরের ভদ্রলোক এবার গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “আপনি ভিতরে এসে বসুন। আমি একটা কাজ সেরে আপনাকে স্লিপ বানিয়ে দিচ্ছি। ও, তার আগে গেটে গিয়ে একটু কনফার্ম করে নিন আপনার কলিগ এখানেই আছেন কিনা।”

গৌতম ঘাড় নেড়ে ভিতরের বড়ো প্রাচীর আর তার সামনের বড়ো গেটটার দিকে পা বাড়াল। সামনেই বিরাট ফলকে লেখা আছে, ‘জেলা সংশোধনাগার।”

নীচে একটা পাথরের ফলকে উদ্‌বোধনের তারিখ সাল ও সেই সময়কার মন্ত্রীর নাম লেখা আছে। কিছু জায়গা অস্পষ্টও হয়ে গেছে। প্রাচীরের একদিকের দেয়ালে কীভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভিতরের তথাকথিত বন্দিদের সঙ্গে দেখা করা যায় তার একটা বিরবণ দেওয়া আছে। লোহার বড়ো দরজা, একটা নয় দুটো। সামনের বড়ো দরজাটার নীচে একটা ছোটো দরজা, কোনওক্রমে একজন মানুষ ভিতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। ওদিকে দু’জন পুলিশকর্মী বসে আছেন। আরেকজন রোগা মতোন ভদ্রলোক সাধারণ পোশাকে ভিতরে ঘোরাঘুরি করছেন।

গৌতম ছোটো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘শুনছেন…?’ বলতেই সেই রোগা ভদ্রলোক এগিয়ে এসে উত্তর দিলেন, ‘বলিয়ে…।’ গৌতম বাংলাতে সঞ্জীবের কথা জিজ্ঞেস করল। উত্তর শুনে নিশ্চিন্ত হল। ততক্ষণে বড়ো লোহার গেটটার কাছে বেশ কয়েকজন জড়ো হয়ে গেছেন। সেই চারজনকেও দেখতে পেল।

গৌতমের চোখে চোখ পড়তেই বয়স্ক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “এখানেই আছে?’

গৌতম মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানাল।

—তাড়াতাড়ি স্লিপটা বানিয়ে নিন। জমা দিলে পরপর দেখা করতে দেয়। বয়স্ক ভদ্রলোক আবার বললেন। গৌতম সম্মতি জানাল। তারপর তাড়াতাড়ি সেই ছোটো ঘরটার সামনে যেতেই ভিতরের ভদ্রলোক নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কলিগ এখানেই আছেন তো?’

গৌতম সম্মতি জানাতেই ভদ্রলোক আবার ঘরের ভিতর ডাকলেন।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...