যত রকম কারণে অতিরিক্ত উদ্বেগ হয়, পরীক্ষার জন্য উদ্বেগ (Exam Anxiety) তার মধ্যে অন্যতম। পরীক্ষার আগে আপনার সন্তান অতিরিক্ত উদ্বেগের শিকার কিনা, তা শনাক্ত করার জন্য কোন লক্ষণগুলির দিকে নজর দেওয়া উচিত, তা জানতে হবে পিতামাতাকে। কেন অতিরিক্ত উদ্বেগের শিকার হচ্ছে পড়ুয়ারা কিংবা উদ্বেগের উপসর্গ চোখে পড়লে কী করতে হবে অভিভাবকদের, সেই বিষয়ে বিশেষ পরামর্শ দিয়েছেন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট প্রজ্ঞাপ্রিয়া মণ্ডল।

অতিরিক্ত উদ্বেগ কী?

পরীক্ষার আগে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব, পরীক্ষা দেওয়ার কৌশল বা অধ্যয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে কম জ্ঞান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারার ভয়, পরীক্ষায় ব্যর্থতার প্রবল ভয় প্রভৃতি থেকেই মূলত অতিরিক্ত উদ্বেগের শিকার হন বেশিরভাগ পড়ুয়া।

উদ্বেগের কারণ

নানারকম ভাবে উদ্বেগের শিকার হন অনেকে। কিন্তু পরীক্ষার আগে পড়ুয়াদের উদ্বেগ বাড়ছে। আসলে, অনেক পড়ুয়া একটি বড়ো ভুল করে। সারাবছর ধীরে ধীরে পরীক্ষার প্রস্তুতি না নিয়ে, পরীক্ষার ঠিক আগেই হঠাৎ খাওয়া-ঘুম ভুলে গিয়ে, রাতদিন মুখ গুঁজে লেখাপড়া করে। অনেক মা-বাবা পরীক্ষার আগেই বেশি করে লেখাপড়া করতে উৎসাহ জোগান সন্তানদের। কিন্তু, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরামহীন লেখাপড়া করা যে কতটা চাপ তৈরি করে সন্তানের শরীরে-মনে, সেই বিষয়ে খুব বেশি ভাবিত নন কিংবা গুরুত্ব দেন না বেশিরভাগ অভিভাবক। কিন্তু পরীক্ষার আগের এই বাড়তি উদ্বেগ আপনার সন্তানের জন্য ভবিষ্যতে চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। আর অতিরিক্ত উদ্বেগ নীরবে ঘাতকের ভূমিকা পালন করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

তাছাড়া, পরীক্ষার সময় টিভি দেখা নেই, গল্পের বই পড়া নেই, ফোনে কথা বলা নেই, পরিবার এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটানো নেই— ঘুম থেকে জেগে শুধু পড়া আর পড়া। ধারাবাহিক ভাবে একা-একা শুধু পড়তে থাকা, একঘেয়েমি তৈরি করে মনের মধ্যে। এর ফলে অনেকে অবসাদের শিকার হন।

পরীক্ষায় ভালো ফল হবে না— এই আশঙ্কাতেও বহু ছেলেমেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। মা-বাবার স্বপ্ন সফল করতে পারবে না, এই হতাশায়ও অনেক সময় আত্মহননের পথ বেছে নেয় কেউ-কেউ। আগে মা-বাবারা সন্তানকে মেধাবী করে তোলার প্রতিযোগিতায় এমন নেমে পড়তেন না। পঠনপাঠন শেষ করে দীর্ঘদিন বেকার হয়ে থাকা সন্তানকে কায়ক্লেশহীন ভাবে মেনেও নেওয়া হতো বহু পরিবারে। এইসব নানারকম কারণে পড়ুয়া এবং অভিভাবক উভয়েরই বাড়ছে উদ্বেগ।

আজকাল তো মনোবিদরা অনেকেই চেষ্টা করছেন মা-বাবাকে বোঝাতে, যাতে সন্তানের উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ তারা সৃষ্টি না করেন নিজেদের স্বপ্নপূরণের প্রত্যাশা নিয়ে। নতুন প্রজন্ম যাতে তার ইচ্ছেমতো বাঁচার পথ খুঁজতে পারে, সেই স্বাধীনতা দেওয়া হোক তাদের— এই বার্তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিটি। অতএব, শুধু মোটা অঙ্কের বেতন পাওয়াই যেন জীবনের লক্ষ্য না হয়, পৃথিবীতে আরও অনেক কিছুই করা যেতে পারে, যা হয়তো জীবনকে সার্থক করে তুলবে। অবশ্য এই ভাবনা অভিভাবকদের মনে কবে আশ্রয় নেবে, তা জানা নেই।

মা-বাবারা মনে করেন, মোটা অঙ্কের ফিজ দিয়ে সন্তানকে নামজাদা স্কুলে পড়ানোর উদ্দেশ্যই হল, তার একটি সুনির্দিষ্ট কেরিয়ার তৈরি করে দেওয়া। এরপর আছে এক্সট্রা-টিউটোরিয়াল, সিলেবাসের বাইরের নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করানোর চাপ।

অবশ্য মা-বাবাকে পুরোপুরি দোষও দেওয়া যায় না। বিপুল প্রতিযোগিতা অতিক্রম করে সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক, তা অভিভাবক মাত্রেই চান। কিন্তু শুধু ভাগ্যগুণে এই সাফল্য আসে না। এর মধ্যে বিপুল পরিশ্রমও জড়িয়ে থাকে। মা-বাবাদের দোষ আরও একটি কারণে দেওয়া যাবে না, তা হল বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে সন্তানরা মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপে আসক্ত। তাই দোষ দেওয়া উচিত প্রযুক্তির আবহকেও, যা ছেলে-মেয়েদের পরিশ্রম বিমুখ করে তুলছে।

দোষ স্কুলের সংগঠকদেরও দেওয়া উচিত, যারা পড়ুয়াদের অতিরিক্ত প্রতিযোগী করে তুলছেন। যে-একনিষ্ঠতা এবং পরিশ্রম সাফল্য এনে দেয়, সেই একাগ্রতা দিয়ে বহু ছেলেমেয়েই পড়াশোনা করে না, ফলে ব্যর্থতা আসছে। যা মেনে নিতে না পেরে তারা উদ্বেগের শিকার হচ্ছে।

সন্তানদের ভাবা উচিত, মা-বাবার প্রত্যাশা বা স্বপ্ন দেখায় অন্যায় নেই। অন্যায় হচ্ছে, নিজেকে ও তাদের ঠকানো। বিনা পরিশ্রমে সাফল্য আসে না। পরিশ্রম না করে পরীক্ষায় বা কেরিয়ারে অকৃতকার্য হয়ে অত্মহননে সমস্যা বাড়ে বই কমে না।

উদ্বেগের উপসর্গ

পরীক্ষার আগে যদি আপনার সন্তান খিটখিটে হয়ে ওঠে কিংবা কথায় কথায় মেজাজ হারিয়ে ফেলে, তাহলে বুঝতে হবে, সে অতিরিক্ত উদ্বেগে রয়েছে। যদি খুব চুপ করে থাকে, তাহলেও তা উদ্বেগের শিকার হওয়ার সংকেত হতে পারে। আর যদি ‘আমি পাশ করতে পারব না’ বলে কান্নাকাটি করে, তাহলে বুঝতে হবে উদ্বেগ বিপদের দরজায় কড়া নাড়াচ্ছে।

মাথা ঘোরা, বমি-বমি ভাব, বমি হওয়া, সবসময় মলমূত্র ত্যাগের বেগ অনুভব করা কিংবা কন্ট্রোল করতে না পারা ইত্যাদি, অতিরিক্ত উদ্বেগে শিকার হওয়া নিশ্চিত করে। আর এরকম পরিস্থিতিতে সন্তানকে নিজে সুস্থ করে তোলার ঝুঁকি না নিয়ে, যত দ্রুত সম্ভব মনোবিদ কিংবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করা উচিত। তবে, উদ্বেগের শিকার হওয়া পড়ুয়াদের চিকিৎসার পাশাপাশি, তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবকদেরই।

উদ্বেগ কমানোর উপায়

কী কী কারণে পরীক্ষার আগে এবং পরীক্ষাকক্ষে আপনার সন্তান বিব্রত বোধ করে, তা জেনে নিন সন্তানের থেকে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয়ই সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরতে পারবে আপনার সন্তান এবং সেই মতো সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারবেন আপনারা। উদ্বেগ কমানোর জন্য পড়ুয়াদের ভেবে নিতে হবে যে, পরীক্ষার উদ্বেগ একটি সাধারণ বিষয় এবং এটি মোকাবিলা করা সম্ভব। অতীতে পরীক্ষার সাফল্যের বিষয়টি মাথায় রেখেও উদ্বেগ কমানো যায়।

পরীক্ষার সময় মানসিক চাপ কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেই বিষয়ে শিক্ষাবিদ এবং মনোবিদের পরামর্শ নিতে পারে পড়ুয়ারা। আর পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লেখা শেষ করতে পারবে কিনা, এই ভয় যদি থাকে আপনার সন্তানের, তাহলে পুরোনো প্রশ্নপত্র নিয়ে বাড়িতে পরীক্ষায় বসান আপনার সন্তানকে। এতে ভয় এবং উদ্বেগ দুটোই কমবে। এছাড়া, নিয়মিত অ্যারোবিক ব্যায়াম করলে পাওয়া যাবে সুফল। পরীক্ষার উদ্বেগ এড়াতে গেলে ক্যাফেইন, চিনি, নিকোটিন কিংবা সবরকম মাদকজাত দ্রব্য থেকে দূরে থাকতে হবে পড়ুয়াদের।

মনে রাখবেন, মস্তিষ্ক বিশ্রাম না পেলে, স্মরণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। যদি আমাদের মস্তিষ্ককে মেমরি স্টোর করার বাক্স হিসাবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে সেই বাক্সটিরও যত্ন নিতে হবে। আর এই যত্ন নেওয়ার মধ্যে প্রধান ভূমিকায় থাকে বিশ্রাম। উদ্বেগ কমাতে হলে, বিশ্রাম নেওয়া আবশ্যক।

যদি সম্ভব হয়, তাহলে সপ্তাহে যে-কোনও একটি দিন, কয়েক ঘণ্টা বাড়ির আশপাশে কোথাও কোনও সুন্দর প্রকৃতিতে নিয়ে যান আপনার সন্তানকে এবং তার সঙ্গে আপনিও কিছুটা সময় কাটিয়ে আসুন

হাসি-মজা করতে করতে। এতে অতিরিক্ত উদ্বেগ দূর হবে। আর জানেন তো, শরীরে স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ না হওয়া আপনার সন্তানের শরীরের পক্ষে ভালো।

লেখাপড়া করার পরে ঘুমানো অত্যন্ত উপকারী। স্মৃতিশক্তি মজবুত করতেও ঘুমের জুড়ি নেই। এছাড়া, প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কিছুক্ষণ আন্তরিক কথোপকথন, প্রাণভরে হাসা, হালকা যোগব্যায়াম করা, অল্প হাঁটাহাঁটি করা কিংবা দশ মিনিটের জন্য নাচ-গান করেও উদ্বেগ কাটানো যায়।

সন্তানের মানসিক ভারসাম্য এবং সুস্থতা বজায় রাখার জন্য চাই পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক আহার এবং চাপমুক্ত মন। এর জন্য সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে অভিভাবকদের। এক্ষেত্রে যদি নিজেরা বিফল হন, তাহলে মনোবিদের সাহায্য নিন সঠিক সময়ে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...