“ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ?

ঠাকুর যাবে বিসর্জন!”

প্রতি বছর বিজয়া দশমীতে দেবীমূর্তির বিসর্জনের সময় এই লাইন দুটো শুনলেই ক্ষেপে যেত বৈদেহী, রেগে গিয়ে বলত — আচ্ছা, এটার মানেটা কী বলো তো মা! অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতেও মা দুগ্‌গার ভাসান হয় কী করে? শুভ শক্তির কি আদৌ কখনও বিসর্জন হয় নাকি?

বাড়ির একমাত্র মেয়ের নাম ‘বৈদেহী’ রাখায় আপত্তি করেছিলেন ঠাকুমা উমাদেবী। ছেলের বউ কৃষ্ণা মানে বৈদেহীর মাকে বলেছিলেন, রামায়ণের সীতামাতা যে জনমদুঃখিনী ছিলেন, বউমা তার নামে মেয়েটার নাম রাখবে? শুনে কৃষ্ণা উত্তরে বলেন, আমার নামটাও তো আপনার মহাভারতের দ্রৌপদীর নামে মা, উনিই বা কী এমন সুখী ছিলেন! তা আমি কি কিছু খারাপ আছি এখন, বলুন তো?

কথাটা অবশ্য তখন কিছু ভুল বলেননি কৃষ্ণা। অন্তত বছর ছয়েক আগে অবধি তো বৃদ্ধা শাশুড়ি, সরকারি চাকুরে স্বামী আর গবেষণারত একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ভরা সংসার ছিল ওনার। ছিল, কিন্তু এখন আর নেই, এখন শুধু অতীতের সুখস্মৃতিটুকু পড়ে রয়েছে ঠাকুর ভাসানের পর জল থেকে ভেসে ওঠা কাঠামোর মতোই!

এইতো ক’দিন আগে বিতান এসেছিল ওর মাকে নিয়ে নিজের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। সামনের নভেম্বর মাসেই বিয়ে; অক্টোবরে পুজোর মধ্যে তো আর এসব কাজ এগোনো সম্ভব নয়, তাই আগেভাগেই বেরিয়ে পড়েছে নিমন্ত্রণপত্র বিলোতে। ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে সম্বন্ধ করে বিয়ে হচ্ছে পোস্ট ডক্টরেট রিসার্চ স্কলার বিতানের। বৈদেহীর ইউনিভার্সিটির সহপাঠী ছিল বিতান। শুধু বন্ধুত্বই নয়, দু’জনের সম্পর্কটা এগিয়েছিল আরও খানিকটা। যার জেরে কৃষ্ণার মনে হল— বিয়ের কার্ডটায় তো কনের জায়গায় ওনার মেয়ের নামটাও থাকতে পারত আজ !

—আচ্ছা, ও কি সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে একবার অন্তত কিছু জানিয়েছিল বিতানকে?” অনেকবার জিজ্ঞেস করবেন ভেবেও কখনও করা হয়ে ওঠেনি প্রশ্নটা।

‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট’ বা সংক্ষেপে ‘নেট’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে “সিএসআইআর’ থেকে স্কলারশিপ পেতে কোনও অসুবিধে না হলেও, রিসার্চ পেপারগুলো ঠিকমতো পাবলিশ না হওয়ায় একটু দুশ্চিন্তাতেই ছিল অন্তর্মুখী বৈদেহী; গবেষণাপত্র প্রকাশনা, ল্যাবে কাজ, থিসিস লেখা ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নানান সমস্যার সম্মুখীন হওয়ায় বেশ কিছুদিন থেকেই খানিকটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল সে।

তবে সেবারটা যেন একটু বেশিই থম মেরে গিয়েছিল মেয়েটা! কারণ জিজ্ঞেস করেও কোনও যুৎসই উত্তর না পেয়ে কৃষ্ণারা ভেবেছিলেন, হয়তো বা রিসার্চের পড়াশোনার চাপ। মেয়ে তাঁর বরাবরই বড্ড মিতভাষী, চাপা স্বভাবের, তাই মা হয়েও মেয়ের মনে কী ঝড় বইছে তা ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পাননি কৃষ্ণা! ঝড়ের আগের সেই ছিল ওর শেষ নিস্তব্ধতা। আর তারপরই তো জন্ম এক অকালপ্রয়াণের অনন্ত নীরবতার!

বহুকাল আগে নিজের অল্প বয়সে সাহিত্যিক শংকরের লেখা ‘কত অজানারে’ বইটা পড়বার সময় কৃষ্ণা একবারও ভাবেননি যে ভবিষ্যতে ষাটের কাছাকাছি বয়সে এসে প্রায় ছয় বছর ধরে নিয়মিত যাওয়া আসায় সেই উপন্যাসে বর্ণিত কলকাতা-র সুপ্রাচীন ‘লাল বাড়িটি’র আনাচ-কানাচ প্রায় একরকম মুখস্থই হয়ে যাবে তার! তবে আজ দীর্ঘ ছয় বছরের অপেক্ষার অবসানে শুনানি, নির্দেশ আর রায়দানের পর নিজের পক্ষের উকিলের সাথে কথা বলে কলকাতা হাইকোর্ট থেকে বেরিয়ে আসতে এই প্রথমবারের মতো যেন একটু স্বস্তিই পাচ্ছিলেন উনি।

প্রখ্যাত রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ল্যাবরেটরি থেকে নিজের একমাত্র মেয়ে বৈদেহীর প্রাণহীন ঝুলন্ত নিথর দেহটাকে নামিয়ে প্রাপ্ত সুইসাইড নোটে দায়ী-অপরাধীর নাম উদ্ধারের পরও যখন পিএইচডি গাইড অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরটিকে ‘বিশাখা অ্যাক্টের’ আওতায় গড়ে ওঠা “ইন্টারনাল কমপ্লেইন্টস কমিটি’ সামান্য শোকজ নোটিসটুকুও ধরাল না আর পুলিশ ও প্রাথমিক পর্যায়ের তদন্ত সেরেই দায় ঝেড়ে ফেলল, তখন বৈদেহীর বাবা মৃতা মেয়ের বদনামের আশঙ্কায় প্রথম দিকে কোর্টে কেস ফাইল করতে মত দেননি। পরে অবশ্য মেয়ের আত্মার শান্তি কামনায় আর স্ত্রী কৃষ্ণার কথায় নিমরাজি হলেও পোড়খাওয়া নিরীহ মানুষটির ধারণা ছিল যে, মেধাবী ছাত্রীর মধ্যবিত্ত পরিবারকে একদিন ওই টাকা আর ক্ষমতার কাছে হার মানতেই হবে। কিন্তু যে চলে গেল সব কিছু ছেড়ে, সে তো আর ফিরে আসবে না। তাই আর কী দরকার এইসব আইন- আদালতের ঝুট-ঝামেলার? উমাদেবী কিন্তু তখন নাতনির সুবিচার পাওয়ার আশায় কেস চালাতে নিজের হাফ-পেনশনের টাকাটা নিজেই দিতে চেয়েছিলেন, যদিও সেটার প্রয়োজন পড়েনি কখনও।

মেয়ে বৈদেহীর হয়ে ন্যায়ের লড়াইয়ে অনেক আইনি জটিলতার মারপ্যাচ এই ক’বছরে ভালোই বুঝতে শিখেছেন কৃষ্ণা। কিন্তু আজও বুঝে উঠতে পারলেন না যে, এখনও যখন এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে তখন আমাদের দেশের ক্রমশ অগ্রগামী সুসভ্য সমাজ কেন হঠাৎ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পুরুষ বনাম নারীতে ভাগ হয়ে যায়? কেন এই ভাগাভাগিটা সত্যি- মিথ্যা, ঠিক-ভুল, উচিত-অনুচিত বা ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে ঘটে না ? মানবিকতার ঊর্ধ্বে কেন স্থান পায় পুরুষতন্ত্র কিংবা নারীবাদ?

আইনের ফাঁকফোকর আর দীর্ঘসূত্রতার মতোই এই বিবাদও কিন্তু সাহায্য করে আসল অপরাধীকে শাস্তির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যেতে, সে তার সামাজিক লিঙ্গ-পরিচয় যাই হোক না কেন! প্রায় সবাই সম্ভাব্য নির্যাতনকারী অথবা নির্যাতিতার চরিত্র ও স্বার্থ বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু সত্যিই ঠিক কী এবং কেন ঘটেছিল— সেই সত্য উদ্ঘাটনের তাগিদ বা আসল সমস্যা প্রতিকার করার উপায়ের খোঁজ কারওর মধ্যেই চোখে পড়ে না।

আসলে রসালো ‘কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি’র গুজব যে নিরপেক্ষ খবরের চেয়ে অনেক বেশি মুখরোচক; কিন্তু, কেউই ভেবে দেখেন না যে, ঠিক কীরকম মানসিক অবস্থা কোনও সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিতে পারে! সত্য সেলুকাস, বড়ো বিচিত্র দেশ…!

নামের সামনে ডক্টরেট আর পিছনে আরও নানান ডিগ্রি ও দেশি-বিদেশি অ্যাওয়ার্ডধারী উচ্চশিক্ষিত সমাজের তথাকথিত সম্মানীয় ‘ভদ্রলোক’টি হাইকোর্টের অর্ডারে সাসপেন্ড হয়ে আজ থেকে পুলিশি হেফাজতে থেকেই যে আরও নামী এবং দামি উকিল ধরে উচ্চতর আইনি স্তরে আবেদন করবে, তা ভালোভাবেই জানেন কৃষ্ণা। তবে তিনিও এখন প্রস্তুত মেয়ের হয়ে আরও বড়ো লড়াইয়ের জন্যে….

আচমকা খেয়াল হয়-— আজ রাত পোহালেই তো কাল ভোরে মহালয়া। দেবীপক্ষের শুরু, প্রায় এক সপ্তাহ পর মায়ের বোধন আর ঠিক তার ক’দিন পরই প্রতিমা নিরঞ্জন। এখন তো কলকাতাতে মহালয়ার দিন থেকেই পুজো-প্যান্ডেলের উদ্বোধন শুরু হয়ে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। দেবী দশভুজাকেও আজকাল ক্লাবের পুজো পাওয়ার জন্য সেলিব্রেটিদের হাতে ফিতে কাটার অপেক্ষা করতে হচ্ছে— ভেবেই একচিলতে তির্যক হাসি খেলে যায় কৃষ্ণার ঠোঁটে!

হাইকোর্ট চত্বর থেকে বেরিয়ে বাসে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকের বাদ্যি সমেত ছোটো ট্রাকের পেছনে মণ্ডপগামী মা দুর্গার কাগজ ঢাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলেন কৃষ্ণ—

‘অসুর থাকছে কতক্ষণ ?

অসুর যাবেই বিসর্জন।’

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...