বিশ্ব উষ্ণায়ন কোনও নতুন খবর নয় এবং এখন এই সমস্যা প্রায় অনিবার্য। আর এই উষ্ণতার কুপ্রভাব প্রতিদিন আমরা টের পাচ্ছি। বাড়ছে রক্তচাপ, তাই অস্থিরতাও বাড়ছে গভীর ভাবে। বিরক্তি এবং ক্লান্তির পাশাপাশি, অনেকে মানসিক অবসাদেরও শিকার হচ্ছেন। এই জলবায়ুগত বিষণ্ণতা যেন চিরসঙ্গী হয়ে উঠছে। কিন্তু পরিস্থিতি যাইহোক, মেজাজ হারালে চলবে না। সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে বের করে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে স্বাভাবিক ভাবে।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই অস্থিরতা দূর করা কি সহজ? মানসিক চাপ বেড়ে গেলে মেজাজ ধরে রাখা কি সম্ভব? সম্ভব। কারণ, বাঁচার জন্য সমস্যার সমাধানের পথ নিজেকেই বের করতে হবে। খারাপ পরিস্থিতির দ্বারা নিজেকে প্রভাবিত হতে দেওয়া চলবে না। কিন্তু কখন বুঝবেন যে, আবহাওয়া কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব আপনার স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি করেছে? এর জন্য আপনাকে প্রথমে বুঝতে হবে ‘জলবায়ু বিষণ্ণতা’-র বিষয়টি। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে, সুপরামর্শ দিয়েছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেবদীপ রায় চৌধুরী।

আসলে, ‘জলবায়ু বিষণ্ণতা’ হল বিশ্রী আবহাওয়ার কারণে উদ্ভূত মানসিক চাপ। যেমন— ভারী বৃষ্টিপাত রাস্তাঘাট জলাবদ্ধ করে, যার ফলে ওই জমা জলে তৈরি হয় পোকামাকড় এবং জীবাণু। ঠিক তেমনই বন্যা, গুমোট গরম প্রভৃতি আমাদের মনে একপ্রকার হতাশা অথবা বিষণ্ণতা তৈরি করে। অর্থাৎ,

O নির্দিষ্ট কোনও কারণ ছাড়াই হতাশা বোধ করা

O ভবিষ্যৎ আরও খারাপ হবে ভেবে ক্রমাগত উদ্বেগ

O আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া

O বিশ্রাম নেওয়ার পরেও ক্লান্তিবোধ করা

O একসময় উপভোগ করা বিষয়গুলিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, ইত্যাদি।

জলবায়ু এবং স্বাস্থ্যের মধ্যে লুকানো যোগসূত্র

অনেকেই হয়তো জানেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জল এবং খাদ্যের গুণমানের উপর কুপ্রভাব ফেলে এবং সেই কারণে আমাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। আর স্বাস্থ্যহানি ঘটলেই আমাদের মন-মস্তিষ্কও দূষিত হয়। যার ফলে, আমাদের চিন্তাভাবনা ঘেঁটে যায়, সংবেদনশীলতা কমে যায় এবং পরিশেষে আমরা মেজাজ হারাতে থাকি।

বিষণ্ণতা বিভিন্ন কারণ এবং কুফল

গুমোট গরম: গ্রীষ্মকালে দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ তাপমাত্রা-র কারণে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা হয় এবং এই বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে ঘুম কম হয়। আর ঘুম কম হলেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং উদ্বেগ অস্থিরতাও বেড়ে যায়।

অতি বৃষ্টি: অপ্রত্যাশিত দীর্ঘস্থায়ী ভারী বর্ষণের ফলে ক্ষেতের ফসলের যেমন ক্ষতি হয়, ঠিক তেমনই ওই ফসলে জন্মানো ব্যাক্টেরিয়া খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের শরীরে গিয়ে স্বাস্থ্যহানি ঘটায়।

বায়ু দূষণ: বায়ুর মান খারাপ হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং দীর্ঘদিন এই সমস্যা হলে শরীরে নানারকম অস্বস্তি হতে পারে এবং রোগ বাসা বাঁধতে পারে।

দুর্যোগের প্রভাব: গত কয়েক বছরে ভারতের বেশ কয়েকটি শহর ভয়াবহ বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে। ওড়িশা, কেরল এবং মুম্বইয়ের কথা সহজেই মনে পড়ে। আর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা খরা-র কারণে যেমন আমাদের সম্পদ নষ্ট হয়, আর্থিক ক্ষতি হয়, ঠিক তেমনই প্রাণহানি ঘটে। বন্যার কারণে পুকুর এবং নদীর জল দূষিত হলে মাছের শরীরেও জীবাণু বাসা বাঁধে এবং ওই মাছ খেয়ে আমাদের শরীরও অসুস্থ হতে পারে। এমন আরও নানারকম কারণে আমাদের স্বাভাবিক ছন্দে বেঁচে থাকা ব্যহত হয়। আর এর কুপ্রভাব পড়ে আমাদের শরীর ও মনে।

আসলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়াও, সবুজ ধ্বংস হওয়া, কংক্রিটের জঙ্গল প্রভৃতির কুপ্রভাবে আমাদের মন-মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটছে। যার ফলেও তৈরি হচ্ছে একরকম বিষণ্ণতা।

সমস্যামুক্ত হওয়ার উপায়

আমরা হয়তো আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। কিন্তু সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে পারি। নিতে পারি শরীর ও মনের যত্ন। রাখতে পারি ইতিবাচক মানসিকতা। মনে রাখতে হবে, দুঃখ, ভয়, রাগ— এইসব খুব সাধারণ আবেগগত বিষয়। আবহাওয়ার খারাপ পরিস্থিতি-র কারণে এইসব সমস্যা তৈরি হতে পারে। কিন্তু এগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল রপ্ত করতেই হবে।

কিছুটা সময় বের করে সকাল- -বিকেল পার্ক কিংবা যানবাহন-মুক্ত শাখা-রাস্তায় হাঁটুন। হালকা ব্যায়াম করুন। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন নানারকম কাজে। আপনজনের সঙ্গে সমস্যা এবং দুঃখ-অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিন প্রয়োজনে। মাঝেমধ্যে বেড়াতে যান কোথাও। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হৃদয়ের নিবিড় সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করুন। মোবাইল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি সময় ব্যয় না করে, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আড্ডা দিন যতটা সম্ভব। আর স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং ইতিবাচক মানসিকতা রাখুন।

মন খারাপ লাগলে যেভাবেই হোক ব্যস্ত রাখুন নিজেকে। ওই সময় কোনও শুভাকাঙ্খীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলুন দূরভাষে কিংবা মুখোমুখি হয়ে। আর কোনও কাজ না থাকলে বাগান পরিচর্যা করুন কিংবা রান্না করুন। লেখার অভ্যাস থাকলে আপনার আবেগ-অনুভূতিগুলো লিখে রাখুন খাতায় কিংবা কম্পিউটার- এ। আর যখন অন্য কিছু কাজ করার ইচ্ছে করবে না, তখন ধ্যান করে নিজের অস্থিরতা কাটান এবং ব্যক্তিত্বে বদল আনার চেষ্টা করুন।

ভেবে নিন, সমস্যা জোয়ারের মতো আসে, আবার কিছু সময় পর ভাঁটার মতো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাই, খারাপ সময় কাটানোর জন্য অপেক্ষা করতেই হবে দৃঢ় ভাবে। কিছু ভালো শখ-আহ্লাদ থাকলে তা পূরণ করার চেষ্টা করুন অস্থির সময় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বিষণ্ণতা কাটানোর জন্য কোনও ভাবেই ধূমপান কিংবা মদ্যপানকে মাধ্যম করবেন না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...