কলকাতায় তখন জমিয়ে শীত। জানুয়ারির প্রথমার্ধ। রাত পৌনে বারোটায় চেন্নাই মেল ছাড়ল। দারিংবাড়িতে না জানি কত শীত! নেট-ঘাঁটা তথ্যে তাপমান চার থেকে পাঁচ! উরিব্বাপ। সাধে বলে — ওড়িশার কাশ্মীর! অতীতে নাকি এখানে বরফপাতের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয়েছে। সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখার বাসনায় যথেষ্ট শীতপোশাক ব্যাগবন্দি করে কলকাতা থেকে সফর শুরু করি।
লম্বা দৌড়
ভোরের সূর্যালোকে চিলিকার সোনালি জলরাশি দেখতে দেখতেই সকাল দশটা নাগাদ ব্রহ্মপুর (চলতি কথায় বেরহামপুর) প্লাটফর্মে নেমে, শীত পোশাক খুলে আবার ব্যাগে ভরে রাখি। কোথায় শীত! মনে পড়ল, কাছেই তো গোপালপুর সমুদ্রসৈকত।
কুকুরাখাণ্ডি বাজার
গাড়ি রেডি। এন এইচ ৫৯ ধরে বড়োবাজার পুলিশ স্টেশনের কাছেই পথ নির্দেশ— বাঁয়ে রায়গাড়া, ডাইনে ফুলবনি, সোজা আশিকা। হ্যাঁ, জায়গার নাম আশিকা। অবাক লাগলেও সত্যি।
বেরহামপুর শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে প্রায় এগারোটা নাগাদ কুকুরাখাণ্ডি বাজার। একটা বড়োসড়ো মিষ্টির দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড়াল প্রাতরাশের জন্য। এমন একটা জায়গায় সাইনবোর্ডহীন দোকানের ভিতর দু’পাশে সারিবদ্ধ চেয়ারগুলো খানেওয়ালাদের দখলে। ভোজ-বাড়ির ফর্মুলায় চেয়ার দখল করে মশলা ধোসা, রাবড়ি এবং মিষ্টি সহযোগে কোনওরকমে উদরপূর্তি সেরে বাইরে চায়ের দোকানে চা পান করে ফের ছুট!

সমলতল থেকে পাহাড়
সারদা মোড় থেকে গাড়ি বাঁদিকের পথ ধরল। পথ নির্দেশ বোর্ডে লেখা— ধারাকোট, বালিগুদা, ভবানীপাটনা, রায়পুর। ধারাকোটের ডানদিকে ঋষিকুল্য নদী এবং জলাধার। বেলা প্রায় একটা। কিছুটা এগিয়ে শুরু হল জঙ্গল, পাহাড়ি পথ৷ এতক্ষণ সমতল পথ দেখে মনে হচ্ছিল, কোথায় দারিংবাড়ি? কোথায় সেই জঙ্গল, পাহাড়? অপ্রত্যাশিত গরম। গায়ের শার্টটাও খুলে শুধুমাত্র স্যান্ডো গেঞ্জি পরে চলেছি ‘ওড়িশার কাশ্মীর’। এমন কথা ছিল কি!
হঠাৎই দৃশ্য পরিবর্তন। শুরু হল জঙ্গল-পথ। গাছ-গাছালির ঘনত্ব বাড়ছে। পথের চেহারা পালটে যাচ্ছে। অজস্র চড়াই আর অসংখ্য ধারালো পাকদণ্ডী। গাড়ির গতির সঙ্গে দৃশ্যপট চোখ-সওয়া হওয়ার আগেই, বাঁকের মোচড়ে শরীরে অস্বস্তি। এমনটা হতো না যদি ঠান্ডার আমেজটা থাকত। রোদ্দুরে গরম, কিন্তু ছায়াতে ঠান্ডার সামান্য আমেজ— এই কি পাঁচ-ছয় ডিগ্রির নমুনা!
এরই মধ্যে কোথা থেকে হনুমান বাবাজিদের হুটোপুটিতে গাড়ির গতি মন্থর। থেমেও গেল। বেশ কয়েকটা হনুমান গাড়ির বনেটে, ছাদের উপর লাফালাফি শুরু করে দিল। গাড়ির চালক তার পাশে রাখা ছোটো ছোটো বিস্কুটের প্যাকেট খুলে হাত বাড়িয়ে দিতেই তা নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতার ধুম। এমনকী বন্ধ কাচের জানলায় উঁকিঝুকি, চোখে প্রশ্ন খাবার আছে তো?
রোমাঞ্চকর পথযাত্রা
দারিংবাড়ি পৌঁছানোর শেষ তিরিশ কিলোমিটার পথে প্রায় তিন হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় আরোহণ পর্ব সত্যিই রোমাঞ্চকর। প্রায় নির্জন জঙ্গল-পাহাড়ি অসংখ্য পাকদণ্ডী পথ পেরিয়ে বেলা প্রায় দুটো নাগাদ দেখা মিলল দারিংবাড়ির ছোট্ট জনপদ। দেখা গেল, বাজার কিংবা হাট শেষবেলার বিকিকিনিতে ব্যস্ত। স্থানীয় বা আশপাশের গ্রাম থেকে আসা মানুষজন, মাথার উপর নীল আকাশ, দু’ধারে লাল মাটির মাঝে কালো পিচ রাস্তা আর সবুজের সমারোহ উপভোগ করতে করতে, পৌঁছে গেলাম ইকো হোমের গেটে।
গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে চোখ বুলিয়ে মনে হল, দারিংবাড়ির এটাই সবথেকে মনোরম পকেট-ফ্রেন্ডলি আবাসস্থল। চমৎকার মরশুমি রংবাহারি ফুল এবং নানা ধরনের গাছেরা সেজেগুজে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল ‘ওড়িশা-র কাশ্মীর’ দারিংবাড়ি-তে। পাহাড়ের উপর আমাদের জন্য নির্ধারিত তিনটি ঘর অবস্থানের দিক দিয়ে সেরা। দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যবস্থা তৈরি। ব্যাগপত্তর ঘরে রেখে, মুখ হাত ধুয়ে হালকা স্নান সেরে সোজা ডাইনিং হল।
ঘরে ফিরে ছোট্ট একটা ঘুম। সেই ঘুম ভাঙল পড়ন্ত বিকেলের আলোয়। আকাশের রং পালটাচ্ছে। সামনে প্রশস্ত ছাদে চেয়ার, টেবিল, গার্ডেন আম্ব্রেলা৷ আলস্য কাটিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। সূর্য ক্রমশ পশ্চিমের পাহাড়শ্রেণির চূড়া ছুঁতে চলেছে। চেয়ারে বসে সূর্যাস্তের যে অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম, তা পরের দিন দারিংবাড়ির সানসেট পয়েন্টে গিয়েও পাইনি।
তারাদের বৈঠকে
চোখের সামনেই কখন যেন সূর্যটা সন্ধ্যার আঁধারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। এবার শীত লাগছে। শীতপোশাক চড়িয়ে এসে সকলে মিলে জমিয়ে আড্ডা। আড্ডার মূল বিষয় যেমন শীতের কথা শুনেছিলাম, তেমনটা কই?
দারিংবাড়ির আকাশে আঁধার নামছে। দূর পাহাড়ের নীলচে-সবুজ রঙের উপর নিউট্রাল কালারের পৌঁচ— গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। দু-একটা পাখির ডাক ছাড়া চারদিক নিস্তব্ধ। ধোঁয়াটে। এও এক অন্ধকারের রূপ! তবে তা কিছুটা ব্যাহত উপত্যকার বসবাসের এলাকায় জ্বলে ওঠা বিজলিবাতির উদ্ভাসে। সান্ধ্যকালীন নৈঃশব্দের দারিংবাড়ির আকাশ ভরে উঠছে অসংখ্য নক্ষত্ররাজির সমাবেশে। তারাদের সেই সমাবেশ দেখতে দেখতে, তাদের কথা শুনতে শুনতে মনে হল— এমন গহন অন্ধকারে রাতের আকাশে তারাদের ঔজ্জ্বল্য কেন কলকাতার আকাশে দেখতে পাই না!
ভোরের সূর্য
খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। তৈরি হতে হবে। আঁধার কাটছে। দূর পাহাড়ের নীলচে সবুজ স্তরে স্তরে মেঘের হালকা তুলির টান। কুয়াশার পর্দাও হতে পারে। চাদর জড়িয়ে বাইরে বেরোলাম। কৌতূহলী দৃষ্টি বরফ খুঁজছে। বরফদানা কোথায়! শীতটাও অদ্ভুত। আবহাওয়া দফতরের ভাষ্য অনুযায়ী— তাপমান চার থেকে ছয় ডিগ্রির মধ্যে অথচ শীতের কামড়ানি নেই। এক আশ্চর্য স্নিগ্ধ শীত। যতদূর মনে হয়, শীতের রাতে যে শিশিরপাত হয়, তা ভোরবেলার ঘাসের উপর পাতলা দানার আকার সৃষ্টি হয়, ওটাই বরফের ভ্রম। তবে, আমরা তার দেখাও পাইনি।
প্রশস্ত ছাদে বসে শীত উপভোগ করতে করতে সূর্যোদয়ের অপেক্ষা। আকাশ লাল হচ্ছে। সেই লালিমার নানান পরতের খেলা দেখিয়ে অবশেষে সূর্যদেব উঁকি দিলেন। আহা! কী তার রূপ! অবাক বিস্ময়ে বরফপাত না দেখার মনখারাপ মুছে দিল সূর্যোদয়ের সোনালি আলোর প্রলেপ।





