চিলাপাতা জঙ্গলের পাশেই আমাদের রাত্রিবাসের ঠিকানা চিলাপাতা জঙ্গল ক্যাম্প। গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরি প্রবেশতোরণ। জায়গাটা চিলাপাতার উত্তর চকয়াখেতি এলাকায়। জঙ্গল ক্যাম্প হাউসের দোতলায় আমাদের ঘর। বিকেলে গেলাম জঙ্গল সাফারিতে। শীলতোর্সা নদীর ধারে অসাধারণ এক নজরমিনার ‘কুনকি’। আজ এখনও পর্যন্ত আমরাই এসে পৌঁছেছি। এখানে দিনেরবেলায় হাতি ঘোরাঘুরি করে। নদীর ধারে কচি ঘাস খেতে আসে হরিণের ঝাঁক। গণ্ডারও আসে, তবে চিলাপাতায় এখন গণ্ডারের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
জনশ্রুতি, কোচবিহারের মহারাজা মৃগয়া করতে এসে একটি গণ্ডারকে মারেন, একটিকে আহত করেন। তাঁর নজরে ছিল আরও চোদ্দটি গণ্ডার। সে বহুযুগ আগের গল্প। নদীর ওপারে জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। চিলাপাতার নজরমিনারগুলির মধ্যে এই সিসি লাইনের নজরমিনারটি নাকি সেরা। সামনের তোর্সার বালুকাবেলা ও ঘাসজমি, হাতি, গাউর, গণ্ডারদের নিরুপদ্রব বিচরণক্ষেত্র। তবে নজরমিনারের মাস্তুলে উঠেও কোনও হিংস্র জন্তু নজরে আসেনি। বিফল হয়েই নীচে নেমে আবার গাড়ির ভিতর সেঁধিয়ে যাই।

গাড়ি চলতে শুরু করে ঘন জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের পাশ কাটিয়ে। ফিসফিসিয়ে কথা বলছি নিজেদের মধ্যে। এই প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত কথা জানানোর ইচ্ছে সামলাতে পারছি না। আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। বাতাসে মাতাল করা বুনো গন্ধ, ঝিঁঝিঁ ডাক, অচেনা পাখির ডাক, নিস্তব্ধ অরণ্যে পাতা ঝরার শব্দ, আর কী চাই।
জনপদগুলির সীমানা মিশে গেছে অরণ্যের আঙিনায়। যেতে যেতে এখানকার রাভা আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলি সিমলাবাড়ি, কুরমাই, নীলপাড়া, আন্দু, বানিয়া বনবস্তি, কোদাল বনবস্তি ঘুরে দেখতে ভালোই লাগে। ওঁরাও, মুণ্ডা, মেচ, রাভা, কোরা, রাজবংশী বিভিন্ন জনজাতির বাস চিলাপাতা অঞ্চলে।

চিলাপাতা অরণ্যের কিছু স্থানে জলদাপাড়া ও বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের মধ্যে হাতি চলাচলের অবাধ পথ। যাকে অরণ্যের পরিভাষায় বলা হয় ‘কোর এরিয়া’। হাতির ধানখেতে আকচার ঢুকে পড়া এখানে নিত্য ব্যাপার। সেই হেতু গাছের মাচায় বসে রাত জেগে, মশাল জ্বালিয়ে, ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, পটকা ফাটিয়ে, হাতির প্রকোপ থেকে ফসল বাঁচানোর লড়াইটাও এখানকার গ্রামবাসীদের জীবনের নিত্য ধারাপাত।





